ডেস্ক রিপোর্ট : বিদায় নিতে যাওয়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ ১০টি পদে রয়েছেন বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শীরা। সরাসরি ছাত্রদল ও শিবিরের রাজনীতি করে এসেছেন এমন দু’জনও রয়েছেন। ২০১৫ সালে জুলাই মাসে ২৮তম সম্মেলনে ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচনের ফলে সিন্ডিকেটের কলকাঠিতে এভাবে ছাত্রদল ও শিবিরের নেতারা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পান। বিষয়টি আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ কারণে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে এবার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অধিকতর যাচাই-বাছাই হচ্ছে। পদপ্রত্যাশী সবার অতীত, পারিবারিক পরিচয়সহ জীবনবৃত্তান্ত এবং সাংগঠনিক ও গোয়েন্দা সংস্থার পাঁচ স্তরের প্রতিবেদন মিলিয়ে দেখে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি সারাদেশে ছাত্রলীগের ১১০টি ইউনিটের অধিকাংশে ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করেছে শিবির-ছাত্রদল, একাত্তরে পাক বাহিনীর সহযোগিতায় গঠিত শান্তি কমিটির প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের সন্তান-স্বজনরাসহ স্বাধীনতা বিরোধীরা। আর এসব অনুপ্রবেশকারীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগকে বারবার বিব্রত হতে হয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক রিপোর্টে সারাদেশের সার্বিক চিত্র উঠে এসেছে। বিষয়টি দলের হাইকমান্ডকে অবহিত করা হয়। যার প্রেক্ষিতে এবার ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলন ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এক মাস আগে থেকেই সিন্ডিকেট ভাঙ্গার ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবার ভোটেরও আয়োজন করা হয়নি। নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষমতা ছাত্রলীগের অভিভাবক শেখ হাসিনার ওপর অর্পণ করেন কাউন্সিলররা।
জানা গেছে, ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে থাকা একজন শিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তার বাবা কট্টরপন্থী সংগঠন জমিয়তে ইসলামের নেতা এবং তার এক ভাই জামায়াতের রোকন ছিলেন। এদিকে এবারও ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীদের তালিকায় ছাত্রদল, শিবিরের সংশ্লিষ্টতা, বিএনপি-জামায়াতমনা পরিবার, হত্যা মামলার আসামি, মাদক ব্যবসায়ী, বিবাহিতরাও রয়েছেন। আওয়ামী লীগ গঠিত কমিটি এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসায় ভাবনায় পড়েছে হাইকমান্ড। শুধু তাই নয়, বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও মহানগর দক্ষিণ শাখায় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা প্রায় ৭০ জনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। চাঁদপুরে বাড়ি এক পদপ্রত্যাশীর বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলকে সুসংগঠিত করার অভিযোগ রয়েছে। তার বাবা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার চাচাতো ভাই শহর শিবিরের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সহ-সভাপতির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, হলে ফাউ খাওয়া, বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হলে আশ্রয় দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে। ২০১৬ সালে মাস্টার দা সূর্যসেন হলে তার কক্ষ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ ও হল প্রশাসন। তার বাবা পাকিস্তান আমলে জামায়াতের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্যের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের আগে ছাত্রদল করার অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, তার পরিবারও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে জানায় তার এলাকার লোকজন। পদপ্রত্যাশী কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর আরেক সদস্যের বিরুদ্ধেও ছাত্রদলের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, ছাত্রলীগে আশ্রয় নেওয়া শান্তি কমিটির সন্তান-স্বজনসহ শিবির-ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকে হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইতিমধ্যে ২০ হাজারের বেশি শান্তি কমিটির সন্তান-স্বজনসহ শিবির-ছাত্রদলের তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ছাত্রলীগে যোগদান করেছেন। কেউ কেউ পেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদ। কেউ কেউ বাবা-ভাই কিংবা স্বজনদের রক্ষা করতে ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছেন। আর দল ভারি করতে অনেক ছাত্রলীগ নেতা অনুপ্রবেশকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে অর্থেরও লেনদেন হচ্ছে। সূত্র জানায়, সংঘবদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যেই স্বাধীনতা বিরোধী আদর্শের মানুষেরা ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় আছেন। একই সঙ্গে অতীত অপকর্ম থেকে রেহাই পাওয়া, দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, আগামী নির্বাচনে জনগণ থেকে দলকে বিচ্ছিন্ন করারও তাদের টার্গেট আছে। অভিযোগ রয়েছে, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, জমি দখল, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যসহ নানা কর্মকাণ্ডে মূল ভূমিকা পালন করছে এসব অনুপ্রবেশকারী। ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের বলেন, কমিটির শীর্ষ পদে যাতে অযাচিত কেউ অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য অধিকতর যাচাই-বাছাই চলছে। তড়িঘড়ি করে ছাত্রলীগের কমিটি করা হবে না। প্রধানমন্ত্রী যথা সময়ে এ কমিটি ঘোষণা দেবেন। এবার ছাত্রলীগের নেতৃত্বে নির্ধারণের ক্ষেত্রে বেশকিছু বিষয় বিবেচনা ও যাচাই করা হচ্ছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ পদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে নামের যে তালিকা গেছে তাতে নারীদের নাম আছে।
প্রসঙ্গত, গত ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শুক্রবার বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলন উদ্বোধন করেন। শনিবার কাউন্সিল অধিবেশনে কাউন্সিলরদের সর্বসম্মতিক্রমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষমতা ছাত্রলীগের অভিভাবক শেখ হাসিনার ওপর অর্পণ করা হয়। এদিকে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে বয়সসীমা ২৭ বছর। তবে দুই বছর মেয়াদের বর্তমান কমিটি ২ বছর ৯ মাস অতিক্রম করায় সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেন ২৮ বছর। পরে এই বয়সসীমার কারণে অনেক যোগ্য নেতা বাদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ অবস্থায় শুক্রবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ওই বয়সসীমা ২৯ বছর পুনর্নির্ধারণের কথা জানিয়ে দেন।