নিউজ ডেস্ক : স্কুলে যাওয়া-অাসার পথে প্রায় দেখা হতো এলাকার ১৯ বছরের তরুণ রাকিবুলের সঙ্গে। ক্রমেই তার প্রতি ভালো লাগা শুরু হয় ১৬ বছরের তরুণী নাসরিন অাক্তারের। সৃষ্টি হয় একে অপরের প্রতি গভীর ভালোবাসা। প্রায় সাত মাস পর্যন্ত চলে লুকিয়ে লুকিয়ে ভালো লাগার এ প্রেম। এরপর শুরু হয় ঘরবাঁধার স্বপ্ন। সিদ্ধান্ত হয় একে অপরকে বিয়ে করার।
কিন্তুু রাজি ছিল না দুই পরিবারের কেউ। তাতেও এতটুকু ফাটল দেখা দেয়নি একে অপরের প্রতি সৃষ্টি হওয়া পবিত্র ভালোবাসার। দুজনে বিয়ে করে ফেলেন দুই পরিবারের অমতে। স্বজনদের থেকে দূরে গিয়ে বাঁধলেন সুখের সংসার। সেখানে স্বামী রাকিবুল শুরু করলেন নির্মাণ শ্রমিকের কাজ (রাজমিস্ত্রি)। এ অায়ে সুখেই চলে যেতো তাদের দুজনের সুখের সংসার। বিয়ের দেড় বছর পর সুখের সংসারে ভালোবাসার সিঁড়ি বেয়ে অাসলো ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান। নাম রাখলেন নুসরাত। ততদিনে দুজনের পরিবার মেনে নিলো তাদের ভালোবাসার সম্পর্ক। বিয়ের পাঁচ বছর পর অারও একটি কন্যা সন্তানের মা হন নাসরিন। তাতে যেন অারও বেশি খুশি স্বামী রাকিবুল। নাম রাখলেন ইসরাত।
এভাবেই চলছিল তাদের সুখের সংসার। অভাব-অনটনে তাদের ভালোবাসা কখনও পরাজিত হয়নি। এক মুহূর্তের জন্যও কেউ কাউকে ছেড়ে যায়নি তারা। তবুও তাদের সাত বছর ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা ভালোবাসার সংসারে যেন এক অশুভ শক্তি ভর করেছিল গত সোমবার (১২ মার্চ) দিবাগত রাতে। এক মুহূর্তেই নাসরিনের ভালোবাসার সুখের সংসার যেন চুরমার হয়ে শূন্যের ওপর একটা দীর্ঘশ্বাস ঠাঁই দাঁড়িয়েছি দৃষ্টির অগোচরে।
রাত অানুমানিক ১২টা। বন্ধু সুজনের কল পেয়ে ঘর থেকে বের হন রাকিবুল (২৬)। কে জানতো ঘর থেকে এ বের হওয়া তাকে চিরদিনের জন্যই বাহিরে রাখবে। বাইরে রাখবে ভালোবাসার মানুষটির অালিঙ্গন থেকেও! স্ত্রীকে না জানিয়ে রাকিবুল অারও চার-পাঁচজন যুবকের সঙ্গে গভীর রাতে বের হন তাদের পরিকল্পনায় সঙ্গী হতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই মিলে যান পাশের গ্রামের একটি বাড়িতে মোটরসাইকেল চুরি করতে। মোটরসাইকেল চুরি করতে গিয়ে স্থানীয় জনতা তাদেরকে ধাওয়া দিলে চার যুবক পালিয়ে গেলেও ধরা পড়েন রাকিবুল। অার তাতেই শুরু হয় জনতার গণপিটিনি! মুমূর্ষু অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। সেইসঙ্গে মৃত্যু ঘটে তিলতিল করে গড়ে তোলা একটি স্বপ্নের।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গের সামনে অশ্রুজলে প্লাবিত হয়ে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা করছিলেন রাকিবুলের স্ত্রী নাসরিন অাক্তার। যাকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল বেঁচে থাকার, যার জন্য পরিবার পরিজন সব ছাড়লো, সেই রাকিবুল তাকেই ছেড়ে চলে গেল। এ যেন নিষ্ঠুর বাস্তবতায় প্রাপ্তির খাতায় শূন্যতাকে বরণ করে নেয়া।
নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার বিরামপুরে সোমবার দিবাগত রাতে চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয় রাকিবুল। পাশেই নারায়ণগঞ্জের অাড়াইহাজার উপজেলার রসুলপুর গ্রামে স্ত্রী ও সাড়ে চার বছরের নুসরাত এবং ১৫ মাস বয়সী ইসরাত নামে দুই মেয়েকে নিয়ে বসবাস করত সে। সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করত রাকিবুল। কাজের সুবাদে সহকর্মী রাজমিস্ত্রি সুজনসহ অারও কয়েকজনের সঙ্গে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। কিন্তুু তারা যে এমন চুরির মতো ঘটনা করবেন স্বামী রাকিবুলকে নিয়ে তা কখনও বুঝতে পারেননি স্ত্রী নাসরিন।
নাসরিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, রাত ৩টায় মোবাইলের শব্দে ঘুম ভাঙে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি রাকিবুলের কল। থমকেই গেলাম। বিছানায় দেখি সে নাই। ফোন রিসিভ করার পর যারা তাকে মেরেছে তাদের একজন অামাকে জিজ্ঞেস করলেন অামি তার কী হই। অামি তার স্ত্রীর পরিচয় দিলাম। একথা শুনে ওই লোক অামাকে বললো, অাপনার স্বামী চুরি করতে এসে জনগণের হাতে ধরা পড়ছে। জনগণ তাকে ব্যাপক মেরেছে। অাপনি এখনই অাসেন। তখন অামি বললাম এত রাতে অামি ছোট ছোট দুইটা মেয়ে নিয়ে সেখানে কীভাবে যাবো। তাদেরকে বাপ-ভাই বলে, কান্নাকাটি করে বলেছি যদি সে কিছু চুরি করে অামি তার জরিমানা দেব, অাপনার তাকে কিছু কইরেন না। এরপর তারা অাশ্বাস দিল সকালে যাওয়ার জন্য।
কিন্তু সকালে সেখানে গিয়ে শুনি রাকিবুলকে নরসিংদী সরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। গিয়া দেখি অামার রাকিবুলকে তারা এত মেরেছে যে, সে কথা পারছে না। শুধু গোংরাচ্ছে। তার হাতের সব অাঙুল, হাতের গিঁরা, পায়ের গিঁরা বুকের হাঁড়, পিঠের হাঁড় সব ভেঙে চুরমার করে ফেলেছে। সেখানখান ডাক্তাররা অামি যাওয়ার পর রাকিবুলকে তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে অাসতে বলে। পরে তাকে নিয়ে দুপুর ১২টায় হাসপাতালে অাসি। ততক্ষণে অামার ভালোবাসার রাকিবুল অামাকে ছেড়ে চলে গেছে।
তিনি অারও বলেন, অামার স্বামী কখনও চুরির মতো কোনো কাজ করেনি। চার-পাঁচ বছর অাগে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে চলাফেরা করত। তাদেরকে অামার সুবিধাজনক মনে না হওয়ায় অামি নিষেধ করার পর থেকে সে অার তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখেনি। কিন্তুু অাজ কী ঘটলো। মানুষ এত নিষ্ঠুর! অামার স্বামীকে মেরে ফেললো। দেশে অাইন অাছে। অামার স্বামী অপরাধ করলে অাইনগতভাবে শাস্তি দিত। কিন্তুু তাক মেরেই ফেললো। এ বিচার অামি কই পাবো। অামার ছোট ছোট দুইটা মেয়ে নিয়ে অামি এখন কই যাবো? স্বামী হারানোর বেদনার অার্তনাতে মায়ের অশ্রুজল মুখ বেয়ে পড়লেও অবুঝ মেয়ে দুইটি এখনও জানে না এর কারণ। জাগো নিউজ