Current Date:Oct 5, 2024

চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে সেবা দেন ম্যাটস শিক্ষার্থীরা!

ডেস্ক রিপোর্ট : পেটের পীড়া সমস্যা নিয়ে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে সাড়ে তিন মাসের শিশু তানিসাকে কমলগঞ্জ থেকে নিয়ে এসেছেন অভিভাবক সাজনা বেগম। কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কক্ষে যান তারা। সেখানে তাদের মতো অনেকেই শিশুদের নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছে আছেন। কক্ষে দু’জন চিকিৎসক চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। তানিসাকে দেখে এন্টিবায়োটিকসহ ব্যবস্থাপত্রে সাতটি ঔষধ লিখে দেন একজন। এর কিছুক্ষণ পর আসলেন বিষেশজ্ঞ চিকিৎসক।

ব্যবস্থাপত্রে ঔষধ বেশি দেখে অভিভাবকদের সন্দেহ হয়। তারা বিষেশজ্ঞ চিকিৎসককে বিষয়টি জানান। তিনি দেখে ব্যবস্থাপত্রের সকল ঔষধ কেটে উপযুক্ত মাত্রার নতুন চারটি ঔষধ লিখে দেন।পরে জানা গেল, আগের ব্যবস্থাপত্রটি লিখেছিলেন মৌলভীবাজারের মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) এর একজন শিক্ষানবিশ শিক্ষার্থী। যে ঔষধগুলো লিখেছিলেন তা এই শিশুর জন্য মোটেই উপযুক্ত ছিল না, বরং ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। অথচ ম্যাটসের শিক্ষানবীশ এসব শিক্ষার্থীরা নিয়মিতই ঔষধের ব্যবস্থাপত্র লিখছেন।

জানা গেল, মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতিতে এভাবেই চলছে বহির্বিভাগের চিকিৎসা সেবা। রোগীদের অভিযোগ সময়মতো সব ডাক্তার হাসপাতালে আসেন না। তাই বাধ্য হয়েই ম্যাটস শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন তারা। আবার অনেকে এসব শিক্ষানবিশ শিক্ষার্থীদের বিষেশজ্ঞ চিকিৎসক মনে করেই সেবা নিচ্ছেন।

রোগীরা জানান, টিকিট কাটার পর কাউন্টার থেকে যে কক্ষে যেতে বলা হয় তারা সেখানেই যান। কে বিষেশজ্ঞ চিকিৎসক আর কে শিক্ষানবিশ দূরদুরান্ত থেকে আসা সাধারণ রোগীরা এসব জানার সুযোগ নেই। ডাক্তারের কক্ষে যিনি বসেন তাকেই ডাক্তার মনে করেন তারা। বহির্বিভাগের মতো আন্তঃবিভাগের একই অবস্থা। রাতে কোন চিকিৎসক থাকেন না। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরাই সেবা দেন।

শহরতলীর সোনাপুর এলাকার মমতা বেগম জানান, তার দাদুর বুকের ব্যথা। হাসপাতালে সকাল ৯টায় এসেছেন। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে চিকিৎক আসেননি। এখন চেম্বারে দেখানো ছাড়া বিকল্প নেই।

অভিযোগ রয়েছে রোগীদের সেবা দিতে অবহেলা করেন অনেক চিকিৎসক। হাসপাতালে যন্ত্রপাতি থাকলেও বিভিন্ন অজুহাতে বাইরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে হয় রোগীদের।

কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীনাথপুর গ্রামের মিনারা বেগম মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করান। তিনি জানান, প্রয়োজনীয় ঔষধ পাচ্ছেন না। এক্স-রে করেছেন বাইরে থেকে। বুকের ব্যথায় রোগী ছটফট করছে কিন্তু চিকিৎসক নেই। কর্তৃপক্ষ রোগীর অবস্থা না দেখেই সিলেটে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন।

হাসপাতালের ল্যাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষার অবহেলা ও একজনের রিপোর্ট অন্যজনকে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলার আশিদ্রোণের জহুরা বেগম অভিযোগ করেন, তিনি তার পরীক্ষার রিপোর্ট আনতে গিয়ে দেখেন তা পাওয়া যাচ্ছে না। পরে শারমীন নামে অন্য রোগীর রিপোর্টের নাম সাদা কালি দিয়ে মুছে তার নাম জহুরা লিখে দেয় তারা। হাসপাতাল থেকে পূর্ণ কোর্স এন্টিবায়োটিক ঔষধ সরবরাহ করার কথা থাকলে তা দেয়া হচ্ছে না।

ব্যবস্থাপনার নানা সংকট রয়েছে জেলার সর্বোচ্চ এই স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসকসহ লোকবলের সংকট রয়েছে। চিকিৎসকসহ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার ৫৩টি পদের বিপরীতে আছেন ৩৫ জন। সেবিকাসহ দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার ১১৪টি পদের বিপরীতে আছেন ৮০ জন। এছাড়া সংকট রয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির লোকবল। ২৫০ শয্যার বিপরিতে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ রোগী ভর্তি হচ্ছেন আন্তঃবিভাগে। হাসপাতালের বহির্বিভাগেও রোগীদের চাপ থাকে প্রতিদিন।

হাসপাতালের নতুন ও পুরোনো ভবনে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টির সময় দুটি ভবনের ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে বিভিন্ন বিভাগে তা জমে থাকে। বিভিন্ন তলার শৌচাগারের পানি দেয়াল চুইয়ে নিচে পড়ছে। এতে রোগী, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

অন্যদিকে, হাসপাতালের পুরোনো ভবনটিতে পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। সেপটিক ট্যাংক উপচে ভবনের জরুরি বিভাগ, সার্জারি বিভাগ ও শিশু বিভাগের শৌচাগার বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবহার করতে হচ্ছে পাশের বিভাগের শৌচাগার।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে হাসপাতালের চারপাশের সীমানা দেয়াল উঁচু করা প্রয়োজন। হাসপাতাল ২৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আবাসিক ভবন সম্প্রসারণ করা হয়নি। ৫০ শয্যার জন্য নির্মিত রন্ধনশালা দিয়ে চলছে ২৫০ শয্যার হাসপাতালের রোগী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খাবার রান্নার কাজ। এটি ২৫০ শয্যার উপযোগী করে পুণনির্মাণ বা সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। হাসপাতালের বর্জ্য ফেলার জায়গাও অপ্রতুল। আন্তঃ ও বহির্বিভাগ পরিষ্কার করার পর যে বর্জ্য বের হয় তা ১০০ শয্যার জন্য নির্মিত ডাস্টবিনে ফেলতে হয়। পৌর কর্তৃপক্ষ নিয়মিত বর্জ্য পরিষ্কার না করায় আশপাশে ময়লার স্তুপ জমে যায়। হাসপাতালে বর্তমানে যে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু আছে তা ভারী চিকিৎসা যন্ত্রপাতি চালানোসহ সার্বিক কার্যক্রমের উপযোগী নয়।

হাসপাতালের নতুন ভবনে র‌্যাম্প (ট্রলি দিয়ে রোগী ওঠানামা করানোর সমতল সিঁড়ি) নেই। এতে বিদ্যুৎ না থাকলে লিফট বন্ধ হয়ে গেলে রোগী নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়।

এসব বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক পার্থ সারথি দত্ত জানান, ম্যাটস শিক্ষানবিশ শিক্ষার্থীরা এখানে শিখতে আসে। তারা ঔষধের ব্যবস্থাপত্র লিখতে পারে না। আমি বিষয়টি দেখছি।

তবে হাসপাতালের সেবার মান আগের চেয়ে বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন করে সিটিস্ক্যান পরীক্ষা ও ডায়ালাইসিস শুরু হয়েছে। তবে লোকবলের অভাবে সিসিইউ আইসিইউ চালু করা যাচ্ছে না।

১৯৮৪ সালে ৫০ শয্যার হাসপাতাল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালটি। ২০০৬ সালে এটি ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়। ২০১২ সালে এটিকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়।

 

Share