স্পোর্টস ডেস্ক: ‘১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে প্রতিবছর বিশ্বকাপ হলে ফ্রান্স দুটি বিশ্বকাপ তো জিততই; তিনটিও জিততে পারত।’
কথাটি মিশেল প্লাতিনির। বড় আক্ষেপভরে বলেছিলেন। অসাধারণ দল নিয়েও পর পর দুই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যে হেরে যায় ফ্রান্স! দুইবারই পশ্চিম জার্মানির কাছে পরাজয়ে। ১৯৮২ সালে টাইব্রেকারে; ১৯৮৬ আসরে ০-২ গোলে হেরে। দুই বিশ্বকাপের মাঝের ইউরোতে ১৯৮৪ সালে কিন্তু ঠিকই শিরোপা জেতে ফরাসিরা। ফ্রান্সের ওই ‘সোনালি প্রজন্ম’র পথচলা তবু থেমে যায় হাহাকার নিয়েই। বিশ্বকাপে চূড়ান্ত সাফল্য পায়নি বলে।
বেলজিয়াম এমন বড় পরাশক্তি কখনোই ছিল না। কিন্তু তাদের ফুটবলেও এসেছিল ‘সোনালি প্রজন্ম’। ১৯৮৬ সালের সেই দলটিও থমকে যায় সেমিফাইনালে। ডিয়েগো ম্যারাডোনার জাদুর সামনে। আর্জেন্টিনার কাছে ০-২ গোলে হারা ম্যাচে দুটি গোলই সেই জাদুকরের। এর মধ্যে একটি তো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শতাব্দীর সেরা গোলকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো।
ফ্রান্স প্রায়শ্চিত্ত করেছে পরবর্তী সময়ে। তাদের আরেক সোনালি প্রজন্ম ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জিতেছে। ২০০০ সালের ইউরোও। কিন্তু বেলজিয়াম আর কখনো বড় টুর্নামেন্টে শিরোপার কাছাকাছি যেতে পারেনি। আর কোনো অমন প্রতিভাবান প্রজন্মও পায়নি অবশ্য। পেয়েছে এবার। গেল চার বছরে যে প্রজন্ম ব্যর্থতার আগুনে পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়েছে। এবার সত্যিকার অর্থে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বিশ্বকাপের। পূর্বসূরিদের দায়মোচনের। পারবে কি পারবে না, সে উত্তর সময়ের হাতে। তবে আজ ফ্রান্সের বিপক্ষে সেমিফাইনালে উতরে গেলে নতুন চ্যাম্পিয়ন দেখার আশা করতেই পারে বিশ্বকাপ। উরুগুয়ে, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, ব্রাজিল, ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, স্পেনের পর… বেলজিয়াম!
সমস্যাটি হলো, আজ তাদের মুখোমুখি হতে হবে ফ্রান্সের। ফরাসি ফুটবলের নতুন সূর্যোদয় যাঁদের হাত দিয়ে হবে বলে বিশ্বাস অনেকের। আন্তোয়ান গ্রিয়েজমান, পল পগবা, কিলিয়ান এমবাপ্পেদের এই প্রজন্মকেও অভিহিত করা হচ্ছে আরেক ‘সোনালি প্রজন্ম’ হিসেবে। ফ্রান্স-বেলজিয়ামের আজকের দ্বৈরথ তাই দুই ইউরোপিয়ান দেশের সোনালি প্রজন্মের লড়াইও বটে!
সম্ভাবনার সলতেটা প্রথম উসকে দেয় ফ্রান্স ১৯৫৮ বিশ্বকাপে। জাঁ ফঁতে, রেমন্ড কোপার সেই দল। প্রতিপক্ষকে গোলবন্যায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে উঠে যায় তারা। কিন্তু গোলবন্যার আরেক ম্যাচে সেখানে হেরে যায় ব্রাজিলের কাছে। ১৭ বছরের ফুটবল-বিস্ময় পেলের হ্যাটট্রিকে ৫-২ গোলে তাদের হারায় ব্রাজিল। ফরাসি ফুটবলের সেটিই প্রথম প্রতিভাবান প্রজন্ম। বছর দুয়েক পর নিজ দেশে আয়োজিত ইউরোতেও ফেভারিট ধরা হচ্ছিল তাদের। কিন্তু এবারও দৌড় সেই সেমিফাইনাল পর্যন্ত। ৪-২ গোল এগিয়েও শেষে ৪-৫ গোলে হেরে যায় যুগোস্লাভিয়ার কাছে। ইনজুরি ও সাময়িক অবসরের কারণে কোপা ও ফঁতের না থাকাটাই শেষ পর্যন্ত গড়ে দেয় পার্থক্য। এরপর ফুটবলাকাশ থেকে ডুবে যায় ফরাসি সূর্য। ১৯৬০ সালের পর টানা পাঁচটি ইউরোতে বাছাই পর্ব উতরাতে পারেনি ‘লে ব্লু’। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পরের দুইবার আটকে যায় বাছাই পর্বের গেরোতে। ১৯৭৮ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের শেষ ম্যাচে বুলগেরিয়াকে হারিয়ে চূড়ান্ত পর্বে যায় বটে তারা; কিন্তু সেখানে ছিটকে যায় প্রথম রাউন্ডেই। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের প্রত্যাবর্তন প্রবল প্রতাপে। প্লাতিনি-তিগানা-জিহেস-ফের্নান্দেসের ‘কারে মাজিক’ অথবা ‘জাদুকরী চতুষ্টয়’-এ চোখ ধাঁধিয়ে যায় বিশ্বের। তবু তারা পারেনি ফাইনাল পর্যন্ত যেতে। বছর দুয়েক পর ইউরোতে অবশ্য শিরোপা জেতে। সেটি প্লাতিনির প্রায় একক কৃতিত্বে। পাঁচ ম্যাচের দলের করা ১৪ গোলর ৯টিই তাঁর। প্রায় অভিন্ন সেই দলটির কাছে তাই প্রত্যাশা ছিল মেক্সিকো বিশ্বকাপ জয়ের। কিন্তু সেমিফাইনালে আবারও মুথ খুবড়ে পড়ে তারা।
আবারও পরের দুই বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের গেরোয় আটকে যায় ফ্রান্স। ’৮৪ ইউরোতে যেভাবে স্বাগতিক হিসেবে খেলার সুযোগ পেয়ে তা কাজে লাগায় দুহাত ভরে; ১৯৯৮ বিশ্বকাপেও তাই। কারণ ততদিনে যে আরেক ‘সোনালি প্রজন্ম’ এসে গেছে! জিনেদিন জিদান, থিয়েরে অঁরি, ফাবিয়ান বার্থেজ, লঁরা ব্ল, লিলিয়ান থুরাম, প্যাট্রিক ভিয়েরাদের সেই দল নিজেদের মাঠে জেতে বিশ্বকাপ। দুই বছর পর গোল্ডেন গোলে ইতালিকে হারিয়ে জেতে ইউরোও। ২০০২ বিশ্বকাপে পারেনি; কিন্তু বুড়িয়ে যাওয়া সেই সোনালি প্রজন্ম নিয়ে ২০০৬ আসরের ফাইনাল পর্যন্ত ওঠে। জিদানের সেই ঢুঁস-কাণ্ড না হলে শিরোপাও হয়তো জিততে পারত ফ্রান্স। শেষে টাইব্রেকারে হেরে যায় ইতালির কাছে।
বেলজিয়ান ফুটবল কখনোই এমন প্রতিভাপ্রসবা নয়। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের দলটিকেই ধরা হয় দেশের সর্বকালের সেরা। দেশকে সেরা সাফল্য এনে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল পর্যন্ত যে নিয়ে যায় এনসো শিফো, জ্যাঁ মারি পাফদেতর সেই দল। টুর্নামেন্টের শুরুটা খুব ভালো হয়নি তাদের। মেক্সিকো, প্যারাগুয়ের পেছনে থেকে গ্রুপে তৃতীয় হয়ে সেরা ছয় তৃতীয় দলের একটি হয়ে যায় নক আউট পর্বে। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন, স্পেনকে হারিয়ে সেমিফাইনালে। সেখানে ‘রেড ডেভিল’রা হেরে যায় ম্যারাডোনার কাছে। আজ যখন সেন্ট পিটার্সবার্গের সেমিফাইনালে খেলতে নামছে দল দুটি, পেছনে তাদের ওই সোনালি প্রজন্মের ছায়া। ফ্রান্সের পেছনে আশির দশকের ইউরোর সাফল্য, বিশ্বকাপের ব্যর্থতা এরপর পরের প্রজন্মে বিশ্বকাপ-ইউরো জয়ের জোড়া সাফল্য। অন্যদিকে বেলজিয়ামের কেবলই ’৮৬-র সেমিফাইনাল পর্যন্ত ওঠা। এবারও সেমি পর্যন্ত উঠে এসেছে তারা। আর এডেন হ্যাজার্ড, রোমেলো লুকাকু, কেভিন দে ব্রুইনে, থিবো কর্তোয়াদের এই দলকে ধরা হচ্ছে ৩২ বছর আগের দলের চেয়ে আরো চৌকস। আরো শাণিত। আরো পরিণত। যদিও তাঁদের পেছনে ২০১৪ বিশ্বকাপ ও ২০১৬ ইউরোতে কোয়ার্টার ফাইনালে ঝরে যাওয়ার হতাশা। ফ্রান্সের এ দলটিরও যেমন বছর দুয়েক আগে নিজ দেশের ইউরোর ফাইনালে পর্তুগালের কাছে হেরে যাওয়ার আক্ষেপ।
এই বিশ্বকাপ দুই দলের সামনেই নিয়ে এসেছে সাফল্যের সম্ভাবনা। একে এক সব বাধা টপকে উঠে গেছে সেমিফাইনালে। রাশিয়া বিশ্বকাপে তাদের খেলার ধরন জল ঢালছে বিশ্বাসের গোড়ায়। সোনালি প্রজন্ম এবার হয়তো এনে দেবে সোনালি সাফল্য। ফ্রান্সের জন্য আবার। বেলজিয়ামের জন্য প্রথমবার।