Current Date:Oct 4, 2024

ব্যাংকিং খাতের সংকট এমডিদের বেতন বিতর্ক উসকে দিয়েছে

ডেস্ক রিপোর্ট : গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে খারাপ সম্পদ বেড়ে গেছে। তারল্য সংকটেও ভুগছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। আগ্রাসী বিনিয়োগের কারণে সীমা ছাড়িয়েছে ঋণ-আমানত অনুপাত (এডি রেশিও)। ব্যাংকিং খাতের এ সংকট উস্কে দিয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) উচ্চ বেতন-ভাতা। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সরকারের মধ্য থেকেও। তবে এ বিতর্ক শুধু বাংলাদেশে নয়, ২০০৮-০৯ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় এমডিদের উচ্চ বেতন-ভাতা নিয়ে একই বিতর্ক উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রেও। ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হলেও উচ্চ বেতন-ভাতা তুলেছিলেন জেপি মরগান অ্যান্ড চেজ ও গোল্ডম্যান স্যাকসের মতো বৃহৎ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা, যা পরে গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

বিভিন্ন দেশে ব্যাংকের এমডিদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় বিভিন্নভাবে। সিইও ব্যাংকের কাছ থেকে বেতন-ভাতা, পারফরম্যান্স বোনাস ও অন্যান্য পেমেন্ট মিলিয়ে নগদ অর্থ পান। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই তারা দায়িত্ব গ্রহণের সময়ই নির্দিষ্টসংখ্যক শেয়ারের মালিকানা দাবি করেন। পারফরম্যান্সের স্বীকৃতিস্বরূপ সেটি বছর বছর আরো বাড়তেও পারে।

উন্নত বাজারগুলোয় দেখা যায়, বছর শেষে শেয়ারের দর বাড়লে সিইও পুরস্কৃত হন, আর কমে গেলে শেয়ারহোল্ডারদের সামনে তাকে জবাবদিহি করতে হয়। এছাড়া ব্যাংকের সম্পদ ও মুনাফা প্রবৃদ্ধি, সম্পদের বিপরীতে রিটার্ন (আরওএ), ইকুইটির বিপরীতে রিটার্ন (আরওই) এ বিষয়গুলোও একজন ব্যাংক সিইওর পারফরম্যান্স মূল্যায়নে ব্যবহূত হয়।

তবে নিজেদের পারফরম্যান্স বাড়িয়ে দেখাতে শীর্ষ নির্বাহীরা যখন ব্যাংকের সম্পদের মানের প্রশ্নটি এড়িয়ে যান, তখন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা। এ সমস্যার সমাধান হিসেবে নির্বাহীদের স্বার্থ আর শেয়ারহোল্ডারের স্বার্থকে কিছুটা হলেও এক সুতোয় গেঁথে দেয়ার প্রচেষ্টা আসে। নিজেও শেয়ারহোল্ডার হলে এবং সে শেয়ার একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধরে রাখতে বাধ্য হলে এজেন্সি প্রবলেমের (ব্যবস্থাপক আর শেয়ারহোল্ডারের স্বার্থের ব্যবহারিক সংঘাত) সমাধানে আন্তরিক হন নির্বাহীরা। শর্ট টার্মিজম ঠেকাতে সিইওদের দেয়া শেয়ারে একটি লকড-ইন পিরিয়ডও বেঁধে দেয়া হয় উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে।

স্টকসহ ২০১৭ সালে গোল্ডম্যান স্যাকস থেকে ২ কোটি ৪০ লাখ ডলার আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন এর প্রধান নির্বাহী লয়েড সি ব্লাঙ্কফেইন। এর মধ্যে মূল বেতন মাত্র ২০ লাখ ডলার। বাকি ২ কোটি ২০ লাখ ডলারের মধ্যে ২ কোটি ডলারই স্টক। গোল্ডম্যান স্যাকসকে প্রত্যাশিত মুনাফা এনে এ আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন ব্লাঙ্কফেইন।

যদিও বাংলাদেশে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা আর্থিক সুবিধার বড় অংশই পাচ্ছেন মূল বেতন হিসেবে। এর বাইরে যা পাচ্ছেন তা বাড়িভাড়া, ইউটিলিটি বিল, উৎসব ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা। ব্যাংক থেকে কোনো স্টক তারা পান না। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব সেভাবে গড়ে ওঠে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের মূল বেতন হয় কম। নিয়োগ দেয়ার আগেই তাকে টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানের পারফরম্যান্স বাড়ানোর। এজন্য শীর্ষ নির্বাহীদের দেয়া হয় নিজ প্রতিষ্ঠানের স্টক। অংশীদারিত্ব গড়ে ওঠায় প্রতিষ্ঠানের পারফরম্যান্সেই তারা বেশি মনোযোগী হন। বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা শুধু বেতননির্ভর হওয়ায় ব্যাংকের ভালো-মন্দের সঙ্গে তাদের খুব বেশি সম্পৃক্ততা থাকে না।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে একজন ব্যাংকার এমডি হন। এমডি পদটি চুক্তিভিত্তিক হওয়ায় এখানে চাকরির ঝুঁকি অনেক বেশি। ব্যাংকের সব দিক এমডিদেরই সামলাতে হয়। বিনিময়ে নির্ধারিত বেতন-ভাতা ছাড়া অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা পান না। বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ট্রেন্ড হলো, শীর্ষ নির্বাহীরা ব্যাংক থেকে স্টক পান। ব্যাংকের ব্যাপ্তি, ব্যবসায়িক সফলতা ও অন্যান্য সূচককে বিবেচনায় নিয়েই এমডিদের স্টক দেয়া হয়। লক্ষ্য পূরণ করতে পারলে এমডিরা মুনাফার অংশীদার হতে পারেন। ফলে এমডিরাও নিজের ব্যাংক মনে করে কাজ করেন। কিন্তু আমাদের দেশে এগুলোর কোনোটিই নেই।

এমডি ও প্রধান নির্বাহীদের স্টক দেয়ার বিষয়ে কিছু বলা নেই ব্যাংক কোম্পানি আইনেও। এমডিদের বেতন-ভাতা বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বেতন-ভাতাদি এবং অন্যান্য সুবিধা ছাড়া প্রধান নির্বাহী অন্য কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুবিধা (যেমন— লভ্যাংশ, কমিশন, ক্লাবের জন্য খরচ ইত্যাদি) পাবেন না।

২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগ প্রজ্ঞাপনটি জারি করে। এতে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাহীর বেতন-ভাতাদি নিরূপণে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা, কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা, ব্যবসার পরিমাণ ও উপার্জন ক্ষমতা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যোগ্যতা ও অতীত কর্মসফলতা, বয়স ও অভিজ্ঞতা এবং সমপর্যায়ের অন্যান্য ব্যাংকে অনুরূপ পদে নিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রদত্ত বেতন-ভাতাদি বিবেচনায় আনতে হবে।

‘মূল বেতন’ ও ‘বাড়িভাড়া’ খাতে প্রত্যক্ষ বেতন এবং ‘অন্যান্য’ খাতে ভাতা সমন্বয়ে মোট বেতন নিরূপণ করতে হবে। ‘অন্যান্য’ খাতে উল্লেখিত ভাতার (যেমন— প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইউটিলিটি বিল, লিভ-ফেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্স) সুনির্দিষ্ট পরিমাণ/সীমা থাকবে। এছাড়া প্রদেয় অন্যান্য সুবিধা (যেমন— গাড়ি, জ্বালানি ও ড্রাইভার) যতদূর সম্ভব অর্থমূল্যে রূপান্তর করে মোট মাসিক বেতন নির্ধারণ করে তা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরিত প্রস্তাবে উল্লেখ করতে হবে। প্রস্তাবে মূল বেতন, গাড়ি ভাতা, উৎসব ভাতা, অন্যান্য ভাতা ও সুবিধাদি (সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে) খাতে টাকার অংক উল্লেখ থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মুখ্য আর্থিক সূচকের (ক্যামেলস) উন্নতি সাধন ব্যতিরেকে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি করা যাবে না।

ব্যাংক এমডিদের আর্থিক সুবিধার মধ্যে স্টক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে ভাবার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে শুরুর দিকে বিদেশী ব্যাংকে চাকরি করা ব্যাংকাররা বড় পদগুলোতে এসেছিলেন। তারা বিদেশী ব্যাংকে বেশি বেতন পেতেন। স্বাভাবিকভাবেই ওই ব্যাংকাররা বেশি বেতনে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে যোগদান করেছেন। তখন থেকেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের বেশি বেতন দেয়ার ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অনেক সময় যোগ্য এমডির সংকট ছিল। বেতন বৃদ্ধির পেছনে এটিও একটি কারণ। নিচের অফিসারদের তুলনায় ব্যাংকগুলোর এমডিদের বেতন অনেক বেশি। বিষয়গুলো আমাদের নজরে আছে। বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমরা ভবিষ্যতে নতুন কিছুও ভাবতে পারি।

এমডিদের বেতন-ভাতা সংক্রান্ত একই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাহীর অনুকূলে ব্যাংক কোনো আয়কর প্রদান করবে না। অর্থাৎ নিয়োগকৃত ব্যক্তিকেই আয়কর প্রদান করতে হবে। বোনাসের বিষয়ে বলা হয়েছে, ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুকূলে উৎসাহ বোনাস সাপেক্ষে প্রধান নির্বাহী উৎসাহ বোনাসপ্রাপ্য হবেন। তবে শর্ত থাকে, প্রধান নির্বাহীর অনুকূলে প্রদেয় ওইরূপ বোনাস বছরে ১০ লাখ টাকার বেশি হবে না।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রধান নির্বাহী ব্যাংকের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা বিধায় পর্ষদ বা পর্ষদ কর্তৃক গঠিত কোনো কমিটির সভায় উপস্থিতির জন্য কোনো সম্মানীও পাবেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক ব্যাংকের এমডি উচ্চ বেতনের কারণে চেয়ারম্যানসহ পরিচালকদের অসন্তুষ্ট করতে চান না। এমডিদের মধ্যে সবসময় পরিচালকদের সন্তুষ্ট রাখার মনোভাব কাজ করে। তাদের মধ্যে চাকরি হারানোর ভয় থাকে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক কেলেঙ্কারির পেছনে এটিও একটি কারণ।

তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাংকগুলোর এমডিদের সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বেতন দিয়ে পারফরম্যান্সের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে এমডিদের ব্যাংকের স্টক দেয়া। সেটি হতে হবে ব্যাংকের পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে। তবে আমাদের দেশের স্টক মার্কেট এখনো সে পর্যায়ে উন্নীত হয়নি।

Share