অনলাইন ডেস্ক : চট্টগ্রামে নিজেদের প্রতিটি অনুষ্ঠানেই যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে হাজির হচ্ছে ছাত্রলীগ। পান থেকে চুন খসলেই জড়িয়ে পড়ছে সংঘাত-সংঘর্ষে। তাদের কাছে শোকসভার যেমন গুরুত্ব নেই, তেমনি গুরুত্ব নেই সিনিয়র নেতাদের আদেশ-নির্দেশেরও। কথায় কথায় সাংবাদিকদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করছে না তারা। দলীয় স্বার্থে নয়, নিজেদের আখের গোছাতে, বীরত্ব দেখাতে কিংবা প্রভাব বিস্তার করতেই তারা মরিয়া। এক সপ্তাহের মধ্যে ছাত্রলীগ চট্টগ্রামে তিনটি আলোচিত ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম কলেজ, এমইএস কলেজ, সিটি কলেজ, মহসিন কলেজকেন্দ্রিক ছাত্রলীগের গ্র“পগুলো প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। লিপ্ত হচ্ছে সংঘাত-সংঘর্ষে।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতার দম্ভ, অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া কিংবা কোনো কোনো পক্ষের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও উসকানিতে ছাত্রলীগ একপ্রকার অন্ধ হয়ে আছে। উঁচু-নিচু সবকিছুই তাদের কাছে সমান মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় ছাত্রলীগের লাগাম কে টানবে, সেটিও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। গতমঙ্গলবার চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মতো একজন প্রবীণ নেতা হাতজোর করে বলার পরও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দমেনি। লিপ্ত হয়েছে সংঘাত-সংঘর্ষে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্রলীগের এহেন আচরণে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মী ও সমর্থকরা হতাশ ও বিব্রত। সাংগঠনিক এবং আইনি ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই তারা দিন দিন বেপরোয়া আচরণ করছে। তাদের এ আচরণ আগামী জাতীয় নির্বাচনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তারা।
হগতমঙ্গলবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে ছিল চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ছিলেন এ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। ড. হাছান মাহমুদ, এমএম ছালামসহ আরও অনেক সিনিয়র নেতা ছিলেন মঞ্চে। কিন্তু মঞ্চের সামনে স্লোগান-পাল্টা স্লোগান নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্র“প জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে। ফাটানো হয় ককটেল। বৃষ্টির মতো চেয়ার ছোড়াছুড়ি হয়। ভাংচুর চলে। পূর্তমন্ত্রী মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাতজোর করে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে সংঘর্ষ ও বিশৃঙ্খলা থামাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু কেউই তার কথা শোনেননি। শেষপর্যন্ত যা হওয়ার হয়েছে। পণ্ড হয়ে যায় সম্মেলন। পূর্তমন্ত্রীসহ অতিথিরা বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে ত্যাগ করেন সম্মেলন স্থল। তাদের কাছে এ যেন অচেনা ছাত্রলীগ।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর কার্যালয়ে ভাংচুর করে ছাত্রলীগ। ভাংচুর করে যানবাহন। সংবাদ কাভার করতে যাওয়া টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ার তিন সাংবাদিককেও তারা মারধর করে। প্রক্টরের অপসারণ দাবিতে ছাত্রলীগের একাংশ অবরোধ পালন করছিল। ওই অবরোধের খবর সংগ্রহ করতে প্রক্টরের কার্যালয়ে কর্তব্যরত সাংবাদিকরা গেলে ছাত্রলীগ ক্ষুব্ধ হয়ে এ হামলা চালায়। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী দুঃখ প্রকাশ করেন। প্রশাসন জড়িত ৮ শিক্ষার্থীকে দুই বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে। কিন্তু ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি এ পর্যন্ত।
গতসোমবার নগরীর লালদীঘি ময়দানে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী স্মরণে শোকসভার আয়োজন করেছিল চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন। উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং নগর আওয়ামী লীগ নেতারা। প্রয়াত নেতার স্মরণে ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল যে শোকসভা, সেই শোকসভাও ছাত্রলীগের একাধিক গ্রুপের মারামারি ও ধাওয়া পাল্টাধাওয়ায় পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। এ শোকসভাও কার্যত পণ্ড হয়ে যায়। পরিস্থিতির কারণে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে নেমে যান প্রধান অতিথি। এ শোকসভা হয়ে উঠেছিল যেন ছাত্রলীগের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের সভা। এখানেও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বারবার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বুঝানোর চেষ্টা করে সংঘর্ষ থামাতে ব্যর্থ হন। গত ২১ জানুয়ারি রাতে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা তিনটি স্থানে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। নাসিরাবাদ সরকারি পলিটেক ইন্সটিটিউট এলাকায় প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে এক ছাত্রলীগকর্মী আহত হন। একই দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের সিট দখলকে কেন্দ্র করে দু’গ্রুপে সংঘর্ষ হয়।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন যুগান্তরকে বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- আজকের ছাত্রলীগ ঐতিহ্যহারা। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি শাহজাদা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’