অর্থনীতি ডেস্ক : ব্যাংকগুলোতে চলছে ভয়াবহ তারল্য সঙ্কট। আর এ সঙ্কট পূরণে আমানত সংগ্রহ অভিযানে নেমেছে ব্যাংকগুলো। প্রত্যেকটা ব্যাংকই তাদের কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা (টার্গেট) দিয়ে দিয়েছে। আমানত সংগ্রহের সুবিধার্থে বাড়তি সুদের স্কিমও ঘোষণা করছে ব্যাংকগুলো। সরকারি ও বিদেশি মালিকানার ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো এমন অভিযানে নেমেছে।
ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেসকারি একটি ব্যাংকের মধ্যমসারির একজন কর্মকর্তার গড়ে প্রতিমাসে ৫০ লাখ টাকা আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ টাকা করে আমানত সংগ্রহ করতে হবে এ সারির একজন ব্যাংকারকে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আরো বেশি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ফলে ব্যাপক মানসিক চাপে রয়েছেন ব্যাংকাররা। ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট এখন এমনই দাঁড়িয়েছে যে, দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থও অনেক ব্যাংকে নেই। ফলে অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হচ্ছে। এজন্য আন্তঃব্যাংক কলমানি সুদহার প্রায় সাড়ে চার শতাংশ হয়ে গেছে। যা ২০১৫ সালের নভেম্বরের পর সর্বোচ্চ। আমানতের সুদহার ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতি হয়েছে।
এদিকে আমদানি-রপ্তানিসহ অন্য প্রায় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাংকের টাকায় পরিচালিত হয়। এসব কার্যক্রমের জন্য চুক্তি মোতাবেক অর্থ চেয়ে পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ফলে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সব ব্যাংকই আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। বিশেষ করে যেসব ব্যাংকের আমানত তুলনায়মূলক কম তারা বেশি বাড়িয়েছে। বেসরকারি খাতের নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে রয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে সুদ ১৩ শতাংশের পর্যন্তও দেওয়া হচ্ছে। যা গত একমাস আগেও এ হার ছিল এক অঙ্কের ঘরে। অর্থাত্ ৯ শতাংশের মধ্যে। অন্যদিকে নতুন ব্যাংকের পাশাপাশি পুরনো ব্যাংকগুলোও আমানতে এখন ১০ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। মূলত অপরিকল্পিতভাবে ঋণ বিতরণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মে ঋণ ও আমানত রেশিও (এডিআর) সমন্বয়, ডলার বাজারে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিরতা, ফারমার্স ব্যাংক কাণ্ডে গ্রাহকদের আস্থাহীনতায় বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকারি আমানত তুলে নেওয়া ও ব্যাসেল-৩ আওতায় বাড়তি মূলধন সংরক্ষণ করতে গিয়ে অধিকাংশ ব্যাংকে তারল্য এ সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গতবছরের শেষের দিকে ব্যাংকিং খাতে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা অলস তারল্য ছিল। গত কয়েক মাসে ঋণ বিতরণের ফলে তা ৮৬ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ঋণই গেছে সরকারি ব্যাংক থেকে। গতবছর ব্যাংকগুলো ৮৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। কিন্তু ঋণ বিতরণ করেছে এক লাখ ৩১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। অর্থাত্ আমানতের তুলনায় ৪৫ হাজার ৪১২ কোটি টাকা বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। এতে অলস অর্থ চলে গেছে। এদিকে তারল্য সংকট মোকাবিলার এরই মধ্যে আকর্ষণীয় মুনাফায় আমানত সংগ্রহের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে বেশ কিছু ব্যাংক। এগুলোর তালিকায় রয়েছে নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলো আগের চেয়ে ২ থেকে প্রায় ৩ শতাংশ পর্যন্ত আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। ফেব্রুয়ারি থেকে মধুমতি ব্যাংক তিনগুণ বৃদ্ধি প্রকল্পে ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ সুদ অফার করেছে। অর্থাত্ এ ব্যাংকে প্রাথমিক টাকা ৯ বছরেই তিনগুণ হবে। এছাড়া ব্যাংকটি দ্বিগুণ বৃদ্ধি প্রকল্পে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে, যা ৬ বছরেই দ্বিগুণ হবে। মাসিক সঞ্চয় প্রকল্পে ৩ বছর মেয়াদে ১১ শতাংশ ও ৫ বছর মেয়াদে সাড়ে ১১ শতাংশ সুদ দিচ্ছে ব্যাংকটি। এছাড়া ৫ বছর মেয়াদী মাসিক আয় প্রকল্পে ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং একবছর মেয়াদী এফডিআরে সাড়ে ৯ শতাংশ সুদ দেওয়া হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি থেকে ফারমার্স ব্যাংক আমানতে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ সুদ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ডিপোজিট পেনশন স্কিম (ডিপিএস) ও মান্থলি ইনকাম স্কিম (এমআইএস) প্রকল্পে মিলছে এ সুবিধা। এছাড়া ব্যাংকটির দ্বিগুণ বৃদ্ধি আমানত প্রকল্পে ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাত্ এখানে প্রাথমিক জমা ৬ বছর ৬ মাসেই দ্বিগুণ হবে।
এছাড়া সাউথ বাংলা ব্যাংক তাদের তিনগুণ বৃদ্ধি প্রকল্পে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। এখানে প্রাথমিক জমা ১০ বছরে তিনগুণ হবে। আর দ্বিগুণ বৃদ্ধি প্রকল্পে সুদ দেওয়া হচ্ছে ১২ শতাংশ। এখানে প্রাথমিক জমা ৬ বছর ৩ মাসে দ্বিগুণ হবে। নতুন প্রজন্মের এনআরবি গ্লোবাল ও মেঘনা ব্যাংকও আমানতের সুদের হার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। বেসরকারি খাতের পুরনো ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও প্রিমিয়ার ব্যাংক তাদের আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে।
বিশেষ করে প্রিমিয়ার ব্যাংক সাড়ে ছয় বছরেই প্রাথমিক জমা দ্বিগুণ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে; আগে যা ৮ বছর ২ মাসে দ্বিগুণ হতো। এবি ও পূবালী ব্যাংক আগের চেয়ে আমানতের সুদহার প্রায় ২ শতাংশ করে বাড়িয়েছে। প্রাইম ব্যাংক ভিন্নধর্মী প্রকল্প চালু করে বেশি সুদ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের আমানতের সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা এ মাসের মধ্যেই আসছে বলে জানা গেছে। সূত্র : ইত্তেফাক