আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গুতা অবরোধের পর সেখানে আমরা এখন একের পর এক নিষ্ঠুর ও নির্মম ঘটনা ঘটতে দেখছি। হতাহত ব্যক্তিদের মতো সেখানকার ঘটনাগুলোও যেন ভাঙা ইট-পাথর আর রক্তের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে পশ্চিমাদের মেকি সহমর্মিতা ও আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার ভান করা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
গুতা অবরোধের নতুন মাত্রা দেখা গেল গত সোমবার। ওই দিন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, আলেপ্পো মুক্ত করার মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা তাঁরা অর্জন করেছেন, সেই অভিজ্ঞতা গুতায় কাজে লাগানো হবে। তাঁর কথার মানে দাঁড়ায় আলেপ্পো থেকে তাঁরা শিক্ষা নেবেন। তাঁর কথায় এই ইঙ্গিত আছে, মুক্ত হওয়ার পর আলেপ্পোর যে দশা হয়েছিল, গুতার অবস্থাও তা-ই হবে। আমাদের আশঙ্কা, মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলেপ্পোর মতো গুতাও ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু আলেপ্পো ও গুতা পুনরুদ্ধার অভিযানের মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা যাচ্ছে। পূর্ব আলেপ্পো দখল করে নেওয়ার আগে সেখান থেকে সাধারণ বাসিন্দাদের বের করে আনার জন্য কয়েক মাস ধরে রুশ সেনারা সিরীয়দের সঙ্গে কাজ করেছে। রুশ ও সরকারি বাহিনী আলেপ্পোর দিকে অগ্রসর হওয়ার পর আমরা সেখান থেকে জনস্রোত বের হয়ে যেতে দেখেছি। তাদের সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহীদেরও নির্বিঘ্নে বের হতে দেওয়া হয়েছিল। আলেপ্পো থেকে বের হয়ে আসা বহু লোককে রুশ বাহিনী তুরস্ক সীমান্তে পৌঁছে দিয়েছে। বহু লোক ‘আইএসের বধ্যভূমি’ হিসেবে পরিচিত ইদলিবে চলে গিয়েছিল। সেই ইদলিব এখনো অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে। আলেপ্পোর বিদ্রোহীদের সঙ্গে তখন রুশ বাহিনীর স্পষ্টতই একটি বোঝাপড়া হয়েছিল।
লাভরভ হয়তো আলেপ্পোর মতো গুতার সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গেও একই ধরনের সমঝোতায় আসার কথা ভাবছেন। রুশ ও সিরীয় বাহিনী যাদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে, সেই সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সব সময়ই ছিল, এখনো আছে। গত বছর বিদ্রোহীদের ঘাঁটি হোমস পতনের পর খাকি পোশাক পরা অবস্থায় রুশ সেনারা সশস্ত্র বিদ্রোহীদের নিরাপদে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইদলিব এলাকায় যেতে দিয়েছে। আমি নিজের চোখে সেই দৃশ্য দেখেছি।
এখন গুতা দখল করে আছে আল নুসরা। এরা মূলত আল-কায়েদার একটি অংশ। এদের আপনি ‘বিদ্রোহী’, ‘সন্ত্রাসী’, ‘ইসলামপন্থী’, ‘সশস্ত্র বিরোধী’, যা হয় পছন্দসই একটা নামে ডাকতে পারেন। এই এলাকার রক্তপাত বন্ধে কাউকেই তেমন উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। আল নুসরা যেহেতু আদি আল-কায়েদার অংশ এবং যেহেতু আল-কায়েদা ২০০১ সালে আমেরিকায় এবং পরে ইউরোপে হামলা চালিয়েছিল, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং ন্যাটো রাশিয়ার এই হামলায় বাধা দিচ্ছে না। তারা সবাই গুতা ধ্বংসে সমর্থন দিচ্ছে। আলেপ্পো থেকে লোকজনকে বের হতে দেওয়া হলেও গুতা থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে গুতা অভিযান পশ্চিমাদের খুবই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। গুতায় যে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ নিহত হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুর্দশার কথাও সবাই বুঝতে পারছে। গাজায় ইসরায়েল হামলা চালানোর পর পশ্চিমারা যেভাবে মৌন থাকার চেষ্টা করে, এখানেও ইসলামপন্থী আল নুসরার দোহাই দিয়ে তারা যতটা সম্ভব মৌন থাকার চেষ্টা করেছে।
গুতায় হত্যাযজ্ঞ নিয়ে যখন আমরা কথা বলা শুরু করেছি, তখন সেখানে রহস্যজনকভাবে সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে অনুপস্থিত দেখতে পাচ্ছি। কোনো পশ্চিমা সাংবাদিক গুতার বিদ্রোহীদের সাক্ষাৎকার নিতে যাননি। তাঁরা বলছেন সেখানে গেলে আল নুসরা তাদের কল্লা কেটে ফেলতে পারে। আমরা সেখানকার যেসব ফুটেজ পাচ্ছি, অবিশ্বাস্যভাবে সেখানে একজন সশস্ত্র মানুষকেও দেখা যাচ্ছে না। সেখানে বোমায় হতাহত শিশুদের রক্তাক্ত দেহের ছবি বীভৎস বিবেচনা করে ভিডিও এডিটররা ছবি অস্পষ্ট করে দিচ্ছেন। বোমায় হতাহত ব্যক্তিদের ছবি দেখাতে পারলেও এই রিপোর্টাররা গুতায় আল নুসরার যোদ্ধা কারা এবং তারা কী করছে, তা দেখাতে পারছেন না।
১৯৪৪ সালে ওয়ারস, ১৯৮২ সালে বৈরুত এবং ১৯৯২ সালে সারায়েভোতে অবরোধের যে আর্কাইভ ফুটেজ আছে, তাতে সেখানকার বিদ্রোহী বাহিনীকে অস্ত্র হাতে লড়াই করতে দেখা গেছে। কিন্তু গুতার ছবি দেখে মনে হবে না, সেখানে বাধা দেওয়ার মতো একজন সশস্ত্র লোকও অবশিষ্ট আছে। তাহলে পশ্চিমা গণমাধ্যমে গুতাকে ‘বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত’ এলাকা বলা হচ্ছে কীভাবে?
লাভরভ দুই দিন ধরে বলছেন, সাধারণ মানুষকে গুতা থেকে বের করে আনার জন্য আল নুসরার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু তারা যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়নি। তার মানে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এই হামলা খুব শিগগির বন্ধ হচ্ছে না। আল নুসরা ও অন্য সশস্ত্র যোদ্ধারা আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত গুতায় অভিযান চলতে থাকবে। আর যখন গুতা ‘মুক্ত’ হবে, তখন সেখানে হয়তো ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।