বাসস : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আবেদন চিরদিনের এবং তা কখনও শেষ হবার নয়। কারণ এরমধ্য দিয়েই মুক্তিকামী বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই ভাষণের আবেদন এখনও মুছে যায়নি। যখনই শুনি তখনই মনে হয় তখনই শরীরের ভেতর কাঁটা দিয়ে ওঠে যে, এ ভাষণ আমাদের জন্য এখনও কতটা প্রযোজ্য এবং সজীব।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই ভাষণ বাঙালির মুক্তিকামী মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের ভাষণ।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রাতে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তিতে ইউনেস্কো কতৃর্ক প্রদত্ত সনদ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে একথা বলেন।
৫টি সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণের হাতে প্রধানমন্ত্রী এই ইউনেস্কোর স্বীকৃতির সনদ তুলে দেন।
প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, বাংলাদেশ বেতার এবং আইসিটি মন্ত্রণালয়াধীন তথ্য ও যোগাযোগ পযুক্তি বিভাগ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং প্রতিষ্ঠান-দপ্তরের প্রধানগণ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই সনদ গ্রহণ করেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন। সনদ গ্রহীতাদের পক্ষে অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই গণভবনের বিশাল পর্দায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রদর্শিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সারাদেশে ভাষা দিবস পালনের উদ্যোগ থেকেই যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শুরু সেখান থেকে ৫২’র রক্তক্ষয়ী ভাষা সংগ্রাম এবং ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমাদের বিজয় অর্জনের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেন।
সমগ্র জাতিকে একতাবদ্ধ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী সারাবিশ্বের অনন্য প্রামাণ্য দলিল হিসেবে এর ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড মেমোরি রেজিষ্টারে অন্তর্ভূক্তিতে তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘৭ মার্চের বক্তৃতা দেয়ার আগে আমার মা বাবাকে বলেছিলেন- তোমার সারাটা জীবন তুমি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছ। তুমি জান এদেশের মানুষের মুক্তি কিসে। কাজেই কারো কথা শোনার কোন প্রয়োজন নাই। তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সেই কথাই বলবে। সেই বক্তৃতাই দেবে।’
পৃথিবীর মানুষের মাঝে অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী যত ভাষণই হয়েছে তারমধ্যে মার্টিন লুথার কিং ছাড়া সব ভাষণই লিখিত ভাষণ ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর এই একটি ভাষণ যেখানে জাতির পিতার হাতে কোন কাগজ ছিল না। কোন নোট, কিছুই ছিল না। এই ভাষণ সম্পূর্ণ তিনি তাঁর মন থেকে বলেছিলেন। যেটি ছিল একটি উপস্থিত বক্তৃতা।
তিনি বলেন, যে ভাষণের মধ্যদিয়ে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এবং মানুষ যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছিল। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল জাতির পিতার নির্দেশে।
ইংল্যান্ডের লেখক গবেষক জ্যাকব এফ ফিল্ডের গবেষণাধর্মী বই ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস, দ্য স্পিচেস দ্যাট ইনস্পারড পিপল’ শীর্ষক বইতে জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ স্থান পেয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আড়াই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ভাষণ, যে ভাষণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে তেমন ৪১টি ভাষণ নিয়ে তিনি এই বইখানা লিখেছেন।
এই বইতে আরো যাদের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাঁদের নাম উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। যারমধ্যে রয়েছেন- আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, জুলিয়াস সিজার, ওলিভার ক্রমওয়েল, জর্জ ওয়াশিনটন, নোপোলিয়ান বোনাপার্ট, জোসেফ গ্যারিবল্ডি, আব্রাহম লিংকন, ভøাদিমির লেনিন, উড্রো উইলসন, উইনস্টন চার্চিল, ফ্্রাংকলিন রুজভেল্ট, চার্লস দ্যা গল, মাও সেতুং, হোচিমিন প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি হিসেবে স্থান পাওয়া বাংলাদেশের জন্যই গৌরবের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই ভাষণটা বাঙালির মুক্তিকামী মানুষের আশা-আকাঙ্খাকে বাস্তবায়ন করার একটা ভাষণ এবং এখানে জাতির পিতা শুধু যে, স্বাধীনতার কথাই বলেছেন তা নয়, বাংলাদেশকে তিনি স্বাধীন করবেন সেইসাথে তিনি যে মানুষকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি এনে দেবেন সেই কথাও ভাষণে উল্লেখ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বলেছেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। অর্থাৎ স্বাধীনতা অর্জনের পর আমাদের যে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে সেই দিক নির্দেশনাও তিনি দিয়ে দিয়েছেন।
এই ভাষণ আমাদের এখনও যে উজ্জীবিত করে তার প্রমাণ হচ্ছে- এই ভাষণ ’৭৫ এর পর নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রতি ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মাদিনে, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে, ১৫ আগস্টের দিনে সব সময় বাজাতেন। আর এই ভাষণ বাজাতে যেয়ে তারা প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।
তিনি বলেন, সেনা স্বৈরশাসকরা যারা একের পর এক ক্ষমতায় এসেছেন, তারা এই ভাষণ বাজাতে দিত না। কিন্তু শত বাধা অতিক্রম করেও আমাদের নেতা-কর্মীরা, মনে হয় মনে একটা জিদ নিয়েই এই ভাষণ বাজিয়েছেন। সেইদিক থেকে মনে হয় এটা হিসেব করে বের করাও সম্ভব নয়, সেই ৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে কত বার, কত দিন, কত ঘন্টা, কত মিনিট এই ভাষণ বাংলাদেশে বেজেছে।
প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা যুদ্ধের কঠিন সময়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বজ্রকন্ঠ নামে প্রতিদিন এই ভাষণ বাজানো হত। আর স্বাধীনতার পরও বিশেষ দিনগুলিতে ভাষণ বাজানো হয়েছে। আর ’৭৫ এ জাতির পিতাকে হত্যার পর এই ভাষণ আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বাজিয়েছে।
পৃথিবীর অন্য ভাষণগুলো একবার হয়ে যাওয়ার পর কিন্তু আর দ্বিতীয়বার বাজেনি। সেই দিক থেকেও ৭ মার্চেও ভাষণ একটা অনন্য দৃষ্টান্ত।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের মূল ভাষণ ২৩ মিনিটের হলেও ১৯ মিনিট রেকর্ড করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অভিনেতা আবুল খায়ের এটা রেকর্ড করে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তাঁকে রেকর্ডটা উপহার দিয়েছিলেন।’
তিনি বলেন, আমি এইটুকু বলবো আজকে এই ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া মানেই আমাদের স্বাধীনতা, মুিক্তযুদ্ধ আমাদের আত্মত্যাগ সবকিছ্ইু সারাবিশ্বে একটা মর্যাদা পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫ এর পর এমন একটা সময় এসেছিল আমাদের বাঙালিদের মাথানিচু করেই চলতে হতো। একদিকে খুনীর দেশ, যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে অন্যদিকে আর্থ-সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ একটা বিধ্বস্ত অবস্থা, দারিদ্র্যের হাহাকার চারিদিকে, সেই পাকিস্তান আমলের বঞ্চনা সবকিছু যেন আবার ফিরে এসেছিল সেখান থেকে আবার আমরা মুক্তি পেয়েছি। আজকে আমরা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছি।
তিনি বলেন, মাত্র সাড়ে তিন বছরে জাতির পিতা একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলে আমাদেরকে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে রেখে গিয়েছিলেন। একেবারে দরিদ্র অবস্থায় রেখে যাননি। যে দেশটার আরো উন্নত হওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনায় ২১টি বছর আমাদের জীবন থেকে নষ্ট হয়ে যায়। তবে, ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করতে পেরেছিলাম বলেই আজকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্রাজুয়েশন লাভ করতে সমর্থ হচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণের শুরুতে বাঙালিদের অধিকার আদায়ে জাতির পিতার জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটানোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ১৯৫৬ সালের করাচি থেকে প্রকাশিত পাকিস্তানের ডন পত্রিকা অনুযায়ী তৎকালীন পূর্ববাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যের চিত্রও তুলে ধরেন।