Current Date:Sep 21, 2024

দুর্নীতি করলে নিজেদের লোকেরও ছাড় নেই : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকার চায় দেশ এগিয়ে যাক, উন্নত হোক। দেশকে নিয়ে আর কেউ ছিনিমিনি খেলুক-সেটি তারা চান না। কেউ দুর্নীতি করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। সন্ত্রাস জঙ্গিবাদে যুক্ত কিংবা অপরাধী যেই হোক, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া দেওয়া হবে না। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। আজ বুধবার দশম জাতীয় সংসদের ১৯তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এদিন সংসদে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ সমাপনী ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর রাষ্ট্রপতির অধিবেশন সমাপ্তির আদেশ পাঠ করার মাধ্যমে স্পিকার শীতকালীন অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধনের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রী কারাগারে যাবেন- সেটি আগেই তারা টের পেয়েছিল কিনা জানি না। রায় হওয়ার আগেই রাতারাতি বিএনপি তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা পরিবর্তন করেছে। এই ধারায় দুর্নীতিগ্রস্ত কিংবা সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি নেতা হতে পারতেন না। রাতারাতি গঠনতন্ত্র সংশোধন করে বিএনপি দুর্নীতিকেই মেনে নিল, দুর্নীতিগ্রস্তকে নেতা হিসেবে মেনে নিল। যে দল দুর্নীতিকে নীতি হিসেবে নেয়, অর্থাৎ দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্তকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়- সেই দল দেশকে কী দিতে পারে?

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের রায় প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আদালত রায় দিয়েছে। এখানে সরকারের তো কোনো হাত নেই। বিচারক রায় দিলেন কেন, সেজন্য অনেক বিএনপি নেতাও হুমকি দেন। তবে কী অপরাধীদের অভয়ারণ্য হবে বাংলাদেশ? এটা তো আমরা হতে দিতে পারি না।’

শেখ হাসিনা বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্ধে যে ধরনের মামলা দিয়েছে, সেই একই ধরনের মামলা তার বিরুদ্ধেও দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের একাউন্ট বন্ধ করে দিয়ে সব কাগজপত্র পরীক্ষা করেছে, এতটুকু ফাঁক পাওয়া যায় কিনা। শত চেষ্টা করেও ট্রাস্টের এতটুকু অনিয়ম তারা পায়নি।

আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, জনগণের ভোটের অধিকার জনগণ ভোগ করবে। তার সরকার দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না। নিজেদের লোককেও ছাড় দেওয়া হয় না। এমনকি মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে, যেকোনো সময় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আদালত থেকেও ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীনভাবে কাজ করছে। আমরা আইন মানি, কখনো নিজেদের দোষকেও ঢাকার চেষ্টা করি না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার বিরুদ্ধে বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়েরকৃত কোনো মামলাই তিনি প্রত্যাহার করতে দেননি। স্পষ্ট বলেছেন, প্রতিটি মামলার তদন্ত হোক। কোথাও এতটুকু ত্রুটি ধরা পড়লে তিনি বিচারের মুখোমুখি হবেন। কারণ তারা রাজনীতি করেন, নিজের ভাগ্য গড়তে নয়, জনগণের ভাগ্য গড়তে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জীবনযাত্রা উন্নয়নের জন্য রাজনীতি করেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে আসা টাকা খালেদা জিয়াসহ তার ছেলে ও অন্যদের আত্মসাৎ প্রসঙ্গে সংসদ নেতা বলেন, এতিমদের জন্য টাকা এসেছিল ২৭ বছর আগে। কিন্তু সেই এতিম টাকা কোথায়? তখনকার দিনে ২ কোটি টাকার অনেক মূল্য ছিল। ওই সময় দুই কোটি টাকা দিয়ে ধানমন্ডিতে ৭-৮টি ফ্লাট কেনা যেত। সেই টাকার লোভ বিএনপি নেত্রী সামলাতে পারেননি। এতিমের হাতে একটি টাকাও তুলে দেননি, পুরো টাকাই মেরে খেয়েছেন।

তিনি বলেন, অন্যদিকে তাদের (শেখ হাসিনা) কিছুই নেই। তবুও তারা দু’বোন ধানমন্ডির পৈতৃক বাড়িটিও জনগণের জন্য দান করে দিয়েছেন। অথচ বিএনপি নেত্রী এতিমের দুই কোটি টাকার লোভ সামলাতে পারলো না। মামলা করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দুদক। এখানে সরকারের দোষ কোথায়? খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে ১০৯ বার সময় নেওয়া হয়েছে। ১০ বছর ধরে মামলা চলেছে। এরপর শাস্তি হয়েছে। শুরুতেই এতিমের টাকা দিয়ে দিলে তো এই মামলা চলতো না। কিন্তু লোভ সামলাতে পারেনি বলেই আজ এ অবস্থা।

খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওযার পর তার ছেলে তারেক রহমানকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, বিএনপি নেত্রী জেলে যাওয়ার পর যাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো সেও দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক ফেরারি আসামী। বিএনপির নেতৃত্বে কী একজনও ছিলো না যে তাকে দায়িত্ব দিতে পারতো? বিএনপির অধিকাংশ নেতার নামেই দুর্নীতির মামলা রয়েছে। কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রয়েছে, কেউ কেউ সাজাপ্রাপ্ত। খালেদা জিয়া জানেন, যাদের দায়িত্ব দেবেন তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির মামলা রয়েছে। বিএনপির সবাই তো দুর্নীতিগ্রস্ত, সবার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। যদি তাই না হয়ে থাকে তাহলে বিএনপি নেত্রী দলে একজনকেও খুঁজে পেলেন না যাকে দায়িত্ব দিয়ে যাবেন। সবকিছু জেনেই বিএনপি নেত্রী যদি দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমানের হাতে দায়িত্ব দিয়ে থাকলে কোনো কিছু বলার নেই।

তিনি বলেন, যে রাজনৈতিক দল দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজকে গ্রহণ করে, সেই দল কীভাবে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারে? এরা হত্যা-দুর্নীতি-লুন্ঠন-অর্থপাচার এসবই করতে পারে, জনগণের কল্যাণ করতে পারে না।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক স্বৈরশাসকদের দুঃশাসন তুলে ধরে তিনি শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন তবে স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতো।

তিনি বলেন, যারা হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল, তারাই বড় গলায় বলে বেড়ায় তারা নাকি বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়েছিল! তিনি প্রতিরাতে কারফিউ দিয়ে দেশ চালাতেন। অর্থাৎ বহুদলীয় গণতন্ত্র নয়, করাফিউ গণতন্ত্র দিয়েছিলেন। এটি জনগণতন্ত্র নয়, কারফিউ গণতন্ত্র।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টার নাম উল্লেখ না করে তার কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তিনি উপদেষ্টা হওয়ার জন্য আমাদের কাছে অনেকবার ধরনা দিয়েছিলেন। আমরা যখন পার্টি থেকে উপদেষ্টার নাম পাঠাই, তখন তার নামটাও পাঠিয়েছিলাম। উপদেষ্টা হওয়ার পর সবার আগে আমাকেই গ্রেফতার করা হলো। আর, আমার বিরুদ্ধে মামলাটা দেওয়া হলো। আমি যখন সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশে ফিরে আসবো, তিনি নিজে আমাকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, থাকো বুনডি তুমি আর আইসো না। বরিশাল-ফরিদপুরে ছোট বোনকে বুনডি বলে ডাকে। সঙ্গে একজন মেজর জেনারেল ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এক ভদ্রলোক এখন দেখি, অনেক বড় বড় কথা বলেন। বেশ জ্ঞানী-গুণী। আমি পার্লামেন্টে সার্কাসের এক গাধার গল্প বলায় তিনি বেশ দুঃখ পেয়েছেন। আমি দেখলাম, অনেক সময় টেলিভিশন টক-শোতে তিনি বলেন, তাদের মতো শিক্ষিত লোকদের নাকি গাধা বলা হয়েছে। আমি তো একটা গল্প বলেছি। এতে কারও যদি আঁতে লাগে, আর সে যদি নিজেকে গাধা মনে করে, আমার কিছু করার নাই। সেই ভদ্রলোকও খুনি হুদা আর পাশাকে নিয়ে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি নামে একটি রাজনৈতিক দলও করেছিল। মঞ্জু ভাই (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) ভালো বলতে পারবেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, যে লোক খুনিদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন, তাদের পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন, সেই টাকা কিসের টাকা? ইত্তেফাকের টাকা? ইত্তেফাকটা কার? হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অর্থে ওই ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের একটা পত্রিকা। যেটা অবশ্য পরে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের আর কোনও অধিকার থাকে না। সেই ইত্তেফাকের অর্জিত সম্পদ দিয়েই ভদ্রলোক বিদেশে ব্যারিস্টারিও পড়ে এসেছেন, সাহেব হয়ে গেছেন। ওই ইত্তেফাকের টাকা দিয়েই তাদের জৌলুস।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইত্তেফাকের টাকা দিয়েই তারা বড়লোক হয়েছেন, অর্থশালী হয়েছেন। এখন কেউ রিকশায় চড়লে হীন চোখে দেখেন। কিন্তু, টাকাটা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের। তার ছেলেটা কী অবস্থায় আছে; সে খবরটাও রাখেন না। ইত্তেফাক পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর অবদান রয়েছে; সে কথা ভুলে গিয়েছিলেন। তার মুখে এখন গণতন্ত্রের সবক শুনতে হয়। বাংলাদেশের জন্য এটাই হলো দুর্ভাগ্যের।

তিনি বলেন, তখন তিনি বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। কিন্তু তাকেই প্রথমেই গ্রেফতার করে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেয়া হলো। রাজনীতি থেকে বিদায় করতে অনেক ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাঁচটি বছর ধরে তারা যে নির্যাতন করেছে তা কল্পনাও করা যায় না। তারা ক্ষমতায় থেকে একদিকে অত্যাচার করেছে, অন্যদিকে সীমাহীন দুর্নীতি করেছে।

বর্তমান সংসদকে কার্যকর ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ভূমিকা রাখায় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ভূমিকার প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী। টানা দুই মেয়াদে তার সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ে তার সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশ হিসেবে পালন করতে চাই। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। বাংলাদেশকে আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলবোই।

এদিকে প্রশ্নোত্তর পর্বে বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের জন্য চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী ও রাজাকারদের কোনো সম্পত্তি স্বাধীন দেশে থাকতে পারে না, রাখার কোনো অধিকার নেই। বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের নামে-বেনামে থাকা সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রথম ধাপ হিসেবে তাদের সম্পত্তি চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

Share