অনলাইন ডেস্ক : খাতুনগঞ্জের চান্দ মিয়া গলিতে বস্তার ব্যবসা করতেন মো. আলমগীর তালুকদার। চট্টগ্রামের আরেক ব্যবসায়ী রুবাইয়া ভেজিটেবলের স্বত্বাধিকারী মো. হারুনের মাধ্যমে ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক হয় তার। এ সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে প্রথম দিকে ছোটখাটো ঋণ নেন তিনি। পরে পণ্য আমদানির নামে বড় অংকের ঋণ নিয়ে সেই টাকা আর ফেরত দেননি। এ ব্যবসায়ীর কাছে চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ২৫ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলমগীর তালুকদারের কাছে সবচেয়ে বেশি পাওনা রয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি)। প্রায় ১০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হওয়ায় আলমগীর ও তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখা। অন্যান্য ব্যাংকের মধ্যে প্রাইম ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার প্রায় সাড়ে ৪ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ৪ কোটি ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক জুবিলী রোড শাখার সাড়ে ৩ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে।
ইউসিবি চট্টগ্রামের জোনাল হেড দিদারুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ২০১২ সালের দিকে কেমিক্যাল আমদানি করতে ঋণ সুবিধা নেন এসএ ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আলমগীর তালুকদার। প্রথম দিকে ঋণের কয়েকটি কিস্তি পরিশোধ করলেও দীর্ঘ সময়ে আর কোনো টাকা দেননি তিনি। বহু চেষ্টার পরও এ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারীর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, প্রথম দিকে ছোটখাটো ঋণ নিলেও সম্পর্কের খাতিরে পরে বড় অংকের ঋণ সুবিধা পান আলমগীর তালুকদার। কিন্তু পণ্য আমদানি ও ব্যবসার নামে ঋণ নিলেও এ ব্যবসায়ী ঋণের টাকায় জমি কিনেছেন; কিনেছেন বিলাসবহুল কয়েকটি ফ্ল্যাট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খাতুনগঞ্জের চান্দ মিয়া গলিতে বস্তা সেলাইয়ের কাজ করতেন আলমগীরের বাবা মো. জানবক্স। এরপর একসময় বস্তার ব্যবসা শুরু করেন। বাবার হাত ধরে বস্তার ব্যবসায় আসেন আলমগীর। ব্যবসার পাশাপাশি বিএনপির অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের দক্ষিণ জেলার সভাপতি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন খাতুনগঞ্জ এলাকায়। রাজনৈতিক দলের নেতা পরিচয় ও তেল ব্যবসায়ী হারুনের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয় তার। এরপর ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেন তিনি। প্রথম দিকে ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধসহ ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ভালো আচরণ করেন। বিশ্বস্ততা তৈরির পর পণ্য আমদানির নামে বড় অংকের ঋণ নেন এসব ব্যাংক থেকে। এরপর পাওনাদার ব্যাংকগুলোর কোনো টাকা পরিশোধ করছেন না। কিন্তু কোনো ব্যাংকে পর্যাপ্ত মর্টগেজ না থাকায় বন্ধকি সম্পত্তি দিয়ে ঋণের সমুদয় টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শাহাদত হোসেন বলেন, ২০০৯ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ঋণ নেয়া শুরু করেন আলমগীর। প্রথম দিকে ছোটখাটো ঋণ নিয়ে যথাসময়ে ফেরত দিতেন। ২০১২-১৩ সালের দিকে আমদানি ব্যবসার নামে বড় অংকের ঋণ সুবিধা নেন। ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন ভালো থাকায় ছোট ব্যবসায়ী হয়েও বড় অংকের ঋণ পেয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, ঋণের টাকা ফেরত পেতে বহুবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু গত কয়েক বছরে কোনো টাকাই পরিশোধ করেননি এ ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাওনা আদায়ে এরই মধ্যে আদালতে মামলা করা হয়েছে।
এদিকে ঋণের টাকা ফেরত না দেয়ায় আলমগীর তালুকদারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন চট্টগ্রামের একটি আদালত। অর্থঋণ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ব্যবসার নামে নেয়া ঋণ ফেরত না দেয়ায় গত বছরের শেষ দিকে এ খেলাপির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক জুবিলী রোড শাখার দায়ের করা মামলায় চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ব্যবসায়ী আলমগীরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ঋণের বিপরীতে দেয়া ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার চেক পাস না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এ মামলা করে।
প্রাইম ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ২০১২-১৩ সালের দিকে ট্রেডিং করতে ঋণ নেন আলমগীর। ছোট উদ্যোক্তা হওয়ার পরও আমদানি ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেন এ ব্যবসায়ী। কিন্তু জমিসহ অনভিজ্ঞ খাতে বিনিয়োগে লোকসান গুনতে হয় তাকে। বিশেষ করে জমি ব্যবসায় মন্দার কারণে জমি বেচাকেনা বন্ধ থাকায় ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। দীর্ঘদিনেও টাকা ফেরত না পাওয়ায় এরই মধ্যে আলমগীরের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে প্রাইম ব্যাংকও। তার কাছে প্রাইম ব্যাংকের বর্তমান পাওনা ৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
ব্যাংকের বড় অংকের খেলাপি হয়ে এক-দেড় বছর ধরে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন আলমগীর তালুকদার। খাতুনগঞ্জ চান্দ মিয়া লেনের মেসার্স এসএ ট্রেডিং বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। জামাল খান প্রেস ক্লাবের পাশের গলি আম্বিয়া সেরিনে সপরিবারে থাকেন তিনি। চকবাজারের অলি খাঁ মসজিদের পাশে তার আরো একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে।
গতকাল মো. আলমগীর তালুকদারের ব্যক্তিগত ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। জামাল খানের বাসায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।