ডা. শরীফ উদ্দিন : সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ২০০৪ সালে এই হার ছিল বছরে মোট ডেলিভারির ৫ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৯ শতাংশ, ২০১১ তে ১৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২৩ শতাংশ। সন্দেহ নেই সিজারিয়ান সেকশনের এই উচ্চহার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চাইতে বেশি।
অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবীরাও সিজারিয়ান সেকশনের উচ্চহারে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং এর জন্য গণহারে চিকিৎসকদের দায়ী করে থাকেন। এমনকি অনেক চিকিৎসকও মনে করেন গাইনোকলজিস্টদের অতিরিক্ত অর্থলিপ্সা এই সিজারিয়ান সেকশনের প্রবণতার জন্য দায়ী।
ফেসবুকে একটা পোস্ট ভাইরাল হতে দেখেছি, কোনো এক অখ্যাত অনলাইন নিউজপোর্টালের। ওখানে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে সিজার করা হয় দুটি কারণে। টাকার জন্য, গাইনির ডাক্তারদের শেখার জন্য। এই নিউজ বাংলাদেশের অনেক সচেতন লোকও বিশ্বাস করেন। তাই আসলে বাংলাদেশে সিজারিয়ান সেকশন বেশি কেনো তা বলার প্রয়োজন অনুভব করছি।
বাংলাদেশে সিজার বেশি হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে-
প্রথমত, গর্ভকালীন মায়ের যে পরিমাণ যত্ন নেয়া দরকার তা নেয়া হয় না। এর ফলে প্রসবের জন্য ডাক্তারের কাছে আসে হাই রিস্ক অবস্থায়। সিজার করানো ছাড়া উপায় থাকে না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের উচ্চমধ্যবিত্ত এবং কর্মজীবী মায়েরা ডেলিভারির পেইন সহ্য করতে রাজি না। ব্যথাবিহীন নরমাল ডেলিভারির জন্য এপিডুরাল দেয়ার ব্যবস্থা বাংলাদেশে অ্যাভেইলেবল না। আমার পরিচিত ডাক্তার দম্পতির কয়েকজন কোনো রকম ইন্ডিকেশন ছাড়াই সিজার করানোর জন্য ডাক্তারকে অনুরোধ করেছেন।
তৃতীয়ত, অধিকাংশ পরিবার বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে রাজি না। নর্মাল ডেলিভারিতে নবজাতক এবং মায়ের মৃত্যুঝুঁকি একটু বেশি।
চতুর্থত, ক্লিনিক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। দালাল ডাইরেক্ট রোগী এনে ক্লিনিকে রাখে। ওটি টেবিলে নেয়ার আগে ক্লিনিকের ম্যানেজার সার্জনকে ফোন দেয়।
পঞ্চমত, গাইনোকলজিস্টের একটা অংশের ব্যস্ততা এবং টাকার লোভ। নর্মাল ডেলিভারির জন্য যে সময় দরকার, সে সময় রোগীকে দেয়া উনাদের পক্ষে সম্ভব হয় না এবং সম্ভব হলেও রোগীর পার্টি সেই সময়ের টাকা দিতে রাজি হয় না।
ষষ্ঠত, জাতিগতভাবে আমাদের এই অঞ্চলের মায়েদের short stature narrow pelvis বেশি থাকে। তাই অবস্ট্রাক্টেড লেবারের হার এই অঞ্চলে বেশি। এ জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি সিজার দরকার হয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত সিজারের জন্য যেভাবে ঢালাওভাবে গাইনোকলজিস্টদের দায়ী করা হয়, তা পুরোপুরি ঠিক না। এবং গাইনোকলজিস্টরা শুধু সৎ হলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। সবার সম্মিলিত সচেতনতাই এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। এ জন্য প্রথমেই আমাদের মায়েদের স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া এবং গর্ভকালীন পরিচর্যা বাড়াতে হবে। নিজেদের সমস্যা নিয়ে সচেতন হওয়া উচিত। চিকিৎসকের প্রতি আস্থার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত ক্ষতির সম্ভাবনা মেনে নিতে হবে। দালাল এবং ক্লিনিকনির্ভর না হয়ে সরাসরি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে আসতে হবে। অতিরিক্ত ব্যস্ত ডাক্তার পরিহার করতে হবে। সবার এ বিষয়টি বুঝতে হবে, গর্ভকালীন এবং পরবর্তী সমস্যার সমাধান যে কোনো গাইনি বিশেষজ্ঞই ভালোভাবে করতে পারেন, প্রফেসরের দরকার হয় না। এবং অবশ্যই আমাদের চিকিৎসকদের অর্থলিপ্সার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, চিকিৎসা পেশার ডিগনিটির কথা ভাবতে হবে। এবং অতি অবশ্যই ভুল চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে, প্রশাসনের অতি উৎসাহ কমাতে হবে। বদনাম আর জেল-জুলুমের ভয় নিয়ে এথিক্যাল প্র্যাকটিস একটু কঠিন।
এর পাশাপাশি এই ধারণা থেকেও বের হয়েও আসা উচিত যে, সিজারিয়ান সেকশন মানে খারাপ আর নরমাল ডেলিভারি মানে খারাপ। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অপ্রয়োজনীয় সিজার যেমন হয়, তেমনি সিজারের ইন্ডিকেশন থাকার পরেও নরমাল ডেলিভারি করতে গিয়ে বাচ্চা এবং নবজাতক দুটোই সংকটাপন্ন হয়েছে। তাই এ সিদ্ধান্ত ডাক্তারদের হাতেই ছেড়ে দিন।
নবজাতক এবং প্রসূতি মা উভয়েই ভালো থাকুক। সবাইকে জাতীয়স্বাস্থ্য দিবসের শুভেচ্ছা।
পুনশ্চ: এই তথ্যটুকু অনলাইন এক্টিভিস্ট ডা. পিনাকী ভট্টাচার্যের ব্লগ থেকে নেয়া। ২০১০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৩৭টি দেশের ওপর অনাবশ্যক সিজারের হারের ওপর চালানো গবেষণার ওপর ভিত্তি করে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যার শিরোনাম The Global Numbers and Costs of Additionally Needed and Unnecessary Caesarean Sections Performed per Year: Overuse as a Barrier to Universal Coverage এই রিপোর্টের প্রথমেই বলে নেয়া হয়েছে সিজারের হার স্বাভাবিকভাবে কত হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১০-১৫% ক্ষেত্রে সিজার করার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে এবং এই পরিমাণটা মা ও অনাগত শিশুর জীবন ঝুঁকিমুক্ত রাখার জন্য জরুরি। এই রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশের সিজারের হার ৭.৫ %, ভারতে ৮.৫%, আমেরিকায় ৩০.৩%, ইংল্যান্ডে ২২%। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হচ্ছে অ্যামেরিকায় অনাবশ্যক সিজারের হার ১০.৮% এবং ইংল্যান্ডে ০.৮%। সিজারের হার পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ব্রাজিলে ৪৫.৯%। আমরা কিউবার স্বাস্থ্যসেবার প্রশংসা করে থাকি সেখানেও সিজারের হার ৩৫.৬%। যুগান্তর
লেখক: ডা. শরীফ উদ্দিন, চিকিৎসক, সার্জারি বিভাগে উচ্চতর প্রশিক্ষণরত।