নিজস্ব প্রতিবেদক : বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার পাশে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সেনা সমাবেশ করেছে মিয়ানমার। সেই সঙ্গে সীমান্ত ঘেঁষে মোতায়েন করা হয়েছে ভারী অস্ত্র। আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ট্রাক, পিকআপ ভ্যান ও লরিতে করে মহাড়া দিয়েছেন মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা। আর মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের শূন্যরেখা থেকে চলে যেতে বলা হয়েছে।
শূন্যরেখায় অবস্থান করা রোহিঙ্গারা যাতে আশ্রয়শিবির থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এতে শূন্যরেখার অবস্থান করা কয়েক হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এ ঘটনায় আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বিজিবির সদর দপ্তরে এক তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমান বলেছেন, ভারী অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি তমব্রু সীমান্তে সেনা সমাবেশ করেছে মিয়ানমার। এ পরিস্থিতিতে সীমান্তে শক্ত ও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তবে মিয়ানমারের সেনাকে পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানানো হয়েছে।
স্থানীয় বিজিবি, উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শূন্যরেখায় থাকা ছয় হাজার রোহিঙ্গার ফিরে যাওয়া রুখতেই সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে মিয়ানমার। তারা বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের চলে যেতে বলছে। বলা হচ্ছে, শূন্যরেখার যে জায়গাটিতে রোহিঙ্গারা থাকছে, তা মিয়ানমারের ভূখণ্ড। সুতরাং সেখানে কাউকে থাকতে দেওয়া হবে না।
ওই শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা দিল মোহাম্মদ (৪৮) বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী শূন্যরেখার পাশে (কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে) গাছে একাধিক মাইক বেঁধে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের দিকে চলে যেতে বলছে। পাশাপাশি গুলিবর্ষণ করে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাতটা থেকে শূন্যরেখার পাশে ভারী অস্ত্র নিয়ে টহল দিতে শুরু করে সে দেশের সেনারা। দুপুর পর্যন্ত কয়েকটি ট্রাকে আনা হয় দেড় শতাধিক সেনাসদস্য। এ সময় ট্রাক থেকে ভারী অস্ত্র ও মর্টারশেল নামাতে দেখা গেছে। কাঁটাতারের বেড়ার খুব কাছে অবস্থান নিয়েছে তাঁরা। সেনাদের সহযোগিতা দিচ্ছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও পুলিশ। সেনা সমাবেশ থেকে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের দূরত্ব মাত্র কয়েক শ গজ। এতে শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাথরকাটা এলাকায় ছোট একটি খালের ওপারে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরটির অবস্থান। শিবিরের পেছন লাগোয়া মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার পাশে মিয়ানমার সীমান্তের উঁচু–নিচু পাহাড়। পাহাড়ের রাস্তায় ভারী অস্ত্র হাতে সেনাসদস্যদের টহল দেওয়ার দৃশ্য এপার থেকে চোখে পড়ে। কাঁটাতারের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সে দেশের অস্ত্রধারী সেনাসদস্যদের। সেনা সদস্যদের কয়েক গজ দূরে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা শিবিরটি। শিবিরে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের চলাফেরা নজরদারি করছে মিয়ানমার সেনারা।
সীমান্তে মিয়ানমারের সেনা সমাবেশ ঘটানোর সত্যতা নিশ্চিত করে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম সরওয়ার কামাল বলেন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্তের শূন্যরেখায় সেনা সমাবেশ ঘটাচ্ছে মিয়ানমার। সকাল থেকে সাতটি ট্রাকে করে ১৭০ জনের মতো সেনাসদস্য তুমব্রু সীমান্তের ওপারে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে আনা হয়েছে। প্রতি ট্রাকে ছিল ২০ থেকে ২৫ জন সেনা। তারা অস্ত্র নিয়ে সেখানে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে শূন্যরেখার ওই আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা আছে ৬ হাজার ২২ জন। আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে এই সেনা সমাবেশ বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে মিয়ানমার কিছু করলে তার জবাব দেবে বাংলাদেশ। নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবিকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি মিয়ানমারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
বিজিবি ও জেলা প্রশাসন সূত্র জানা যায়, শূন্যরেখায় পড়ে থাকা ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাখাইন রাজ্যের ঢেকুবনিয়ায় দুই দেশের (বাংলাদেশ-মিয়ানমার) প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে শূন্যরেখায় থাকা ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব দিলে মিয়ানমার শর্তসাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেয়। এরপর দুই দেশের প্রতিনিধিরা শূন্যরেখার ওই আশ্রয়শিবিরে গিয়ে কথা বলেন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে।
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন। তিনি বলেন, শূন্যরেখায় সেসব রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, ওই জায়গাটা মিয়ানমারের কাঁটাতারের খুব কাছে। কাঁটাতারের পরেই (আশ্রয়কেন্দ্রের পেছনে) রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি। যাচাই-বাছাই শেষে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবির থেকেই নিজগ্রাম রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার আগে উত্তেজনা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে।
গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে রাখাইন রাজ্যে থেকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পালিয়ে আসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এর আগে আসে আরও চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা। মোট ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে ইতোমধ্যে ১০ লাখ ৭৬ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম আলো