অনলাইন ডেস্ক : বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের ওপরে অতিরিক্ত সেনাসমাবেশ করেছে মিয়ানমার। একই সঙ্গে তারা সীমান্ত ঘেঁষে ভারী অস্ত্র মোতায়েন করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তমব্রু সীমান্তে ফাঁকা গুলির শব্দ শোনা গেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
শূন্যরেখায় অবস্থান করা রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, এ জন্য সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা সমাবেশের কারণ জানতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) কাছে পতাকা বৈঠকে বসার অনুরোধ জানিয়েছে বিজিবি। এই অনুরোধে সাড়া মেলেনি।
ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূততে গতকাল বিকেলে তলব করা হয়েছে। সীমান্ত থেকে অবিলম্বে মিয়ানমারের সেনাদের সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।
সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাসমাবেশের বিষয়ে গতকাল বিকেলে রাজধানীর পিলখানার বিজিবি সদর দপ্তরে ব্রিফিং হয়। ব্রিফিংয়ে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড ট্রেনিং) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমান বলেন, তমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় মিয়ানমার সীমান্তের দিকে কিছু রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের সেখান থেকে অন্যত্র চলে যেতে বলা হচ্ছে। গতকাল সকালে তমব্রু বর্ডার পোস্টের ৩৪ ও ৩৫ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি সেনাসমাবেশ ঘটায় মিয়ানমার। সীমান্তের ওপারে প্রায় দেড় শ গজের মধ্যে তারা চলে আসে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিজিবি সীমান্তে শক্ত ও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
মুজিবুর রহমান জানান, এ বিষয়ে পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রতিবাদলিপিও পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সাড়া দেয়নি।
বিজিবি, উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়া রুখতেই সীমান্তে সেনাসমাবেশ ঘটিয়েছে মিয়ানমার। তারা বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের চলে যেতে বলে। বলা হচ্ছে, শূন্যরেখার যে জায়গাটিতে রোহিঙ্গারা থাকছে, তা মিয়ানমারের ভূখণ্ড। সুতরাং সেখানে কাউকে থাকতে দেওয়া হবে না।
ওই শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা দিল মোহাম্মদ বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকেই মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীরা শূন্যরেখার পাশে (কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে) গাছে একাধিক মাইক বেঁধে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের দিকে চলে যেতে বলছে। পাশাপাশি গুলিবর্ষণ করে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শূন্যরেখার পাশে ভারী অস্ত্র নিয়ে টহল দিতে শুরু করে মিয়ানমারের সেনারা। দুপুর পর্যন্ত কয়েকটি ট্রাকে আনা হয় দেড় শতাধিক সেনাসদস্য। এ সময় ট্রাক থেকে ভারী অস্ত্র ও মর্টারশেল নামাতে দেখা গেছে। কাঁটাতারের বেড়ার খুব কাছে অবস্থান নিয়েছে তারা। সেনাদের সহযোগিতা দিচ্ছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও পুলিশ। সেনাসমাবেশ থেকে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের দূরত্ব মাত্র কয়েক শ গজ। এতে শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাথরকাটা এলাকায় ছোট একটি খালের ওপারে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরটির অবস্থান। শিবিরের পেছন লাগোয়া মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার পাশে মিয়ানমার সীমান্তের উঁচু-নিচু পাহাড়। পাহাড়ের রাস্তায় ভারী অস্ত্র হাতে সেনাসদস্যদের টহল দেওয়ার দৃশ্য এপার থেকে চোখে পড়ে। কাঁটাতারের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সে দেশের অস্ত্রধারী সেনাসদস্যদের। সেনা সদস্যদের কয়েক গজ দূরে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা শিবিরটি। শিবিরে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের চলাফেরা নজরদারি করছে মিয়ানমার সেনারা।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম সরওয়ার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্তের শূন্যরেখায় সেনাসমাবেশ ঘটিয়েছে মিয়ানমার। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কয়েকটি ট্রাকে করে সেনাসদস্যদের তুমব্রু সীমান্তের ওপারে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে আনা হয়। প্রতি ট্রাকে ছিল ২০ থেকে ২৫ জন সেনা। তারা অস্ত্র নিয়ে সেখানে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে এই সেনাসমাবেশ বলে জানা গেছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গারা। শিবিরের পেছনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। শিবিরের সামনে খালের এপারে বাংলাদেশ সীমান্ত। ছবি: প্রথম আলো
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গারা। শিবিরের পেছনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। শিবিরের সামনে খালের এপারে বাংলাদেশ সীমান্ত। ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে মিয়ানমার কিছু করলে তার জবাব দেবে বাংলাদেশ। নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবিকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি মিয়ানমারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
বিজিবি ও জেলা প্রশাসন সূত্র জানা যায়, শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাখাইন রাজ্যের ঢেকুবনিয়ায় দুই দেশের (বাংলাদেশ-মিয়ানমার) প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব দেওয়া হয়। মিয়ানমার শর্তসাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেয়। এরপর দুই দেশের প্রতিনিধিরা শূন্যরেখার ওই আশ্রয়শিবিরে গিয়ে কথা বলেন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন। শূন্যরেখায় সেসব রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, ওই জায়গাটা মিয়ানমারের কাঁটাতারের খুব কাছে। কাঁটাতারের পরেই (আশ্রয়কেন্দ্রের পেছনে) রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি। যাচাই-বাছাই শেষে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবির থেকেই নিজগ্রাম রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার আগে উত্তেজনা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে।
গত বছরের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন থেকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পালিয়ে আসে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তার আগে আসে আরও ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। প্রায় ১১ লাখের মধ্যে ইতিমধ্যে ১০ লাখ ৭৬ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে।