ফাইনাল হলো ঠিক ফাইনালের মতোই। দুই দলের লড়াই হলো একদম শেষ বল পর্যন্ত। শেষ বলে জয়ের জন্য ফরচুন বরিশালকে করতে হতো ৩ রান। কিন্তু মাত্র ১ রান নিতে পেরেছেন স্ট্রাইকে থাকা ব্যাটার তৌহিদ হৃদয়। যার ফলে মাত্র ১ রানের জয়ে তৃতীয়বারের মতো বিপিএলের চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।
আগে ব্যাট করে কুমিল্লার সংগ্রহ ছিল ১৫১ রান। ঝড়ো ব্যাটিংয়ে মাত্র ২৩ বলে ৫৭ রান করেছিলেন সুনিল নারিন। বিপরীতে পুরো ২০ ওভার খেলে ৮ উইকেট হারিয়ে ১৫০ রানে থেমেছে বরিশালের ইনিংস। বল হাতেও ৪ ওভারে মাত্র ১৫ রানে ২ উইকেট নিয়ে কুমিল্লার জয়ের নায়ক সুনিল নারিন।
এ নিয়ে তিনবার ফাইনালে উঠে তিনবারই রানার্সআপ হয়ে শেষ করতে হলো বরিশালকে। ২০১২ সালে প্রথম আসরে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের কাছে হারের পর, ২০১৫ সালে কুমিল্লার কাছেই ফাইনাল হেরেছিল বরিশালের দল। এবার দ্বিতীয়বারের মতো কুমিল্লার কাছে হেরে হতাশায় আসর শেষ হলো বরিশালের।
অন্যদিকে ২০১৫ ও ২০১৯ সালের পর এবার তৃতীয়বারের মতো শিরোপা জিতলো কুমিল্লা। মাশরাফি বিন মর্তুজার পর মাত্র দ্বিতীয় অধিনায়ক হিসেবে বিপিএলে একের অধিনায়ক শিরোপা জিতলেন ইমরুল কায়েস। অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন চারবার। এছাড়া অন্য দুইবার শিরোপা উঠেছে সাকিব আল হাসান (২০১৬) ও আন্দ্রে রাসেল (২০২০)।
আজকের রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল ম্যাচটিতে কুমিল্লার ছুড়ে দেওয়া মাঝারি লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মোস্তাফিজুর রহমানের করা প্রথম ওভারে কোনো রানই নিতে পারেননি বরিশালের ফর্মে থাকা ওপেনার মুনিম শাহরিয়ার। তবে সেই ওভারে ৪টি ওয়াইড বল করেন মোস্তাফিজ। পরের ওভারের দ্বিতীয় বলেই ৭ বলে ০ রান করা মুনিমকে ফিরিয়ে দেন শহিদুল ইসলাম।
তবে মুনিমের অভাব একদমই বুঝতে দেননি জিয়াউর রহমানের জায়গায় আজকের ফাইনালে সুযোগ পাওয়া সৈকত আলি। তিন নম্বরে নেমে শহিদুলের সেই ওভারের শেষ তিন বলে হ্যাটট্রিক বাউন্ডারি হাঁকান সৈকত। যা সরিয়ে দেয় শুরুর চাপটা। এরপর আর থামতে হয়নি ডানহাতি এ ব্যাটারকে।
অবশ্য সুনিল নারিনের করা পরের ওভারেই ফিরতে পারতেন সাজঘরে। ইনিংসের তৃতীয় ওভারের চতুর্থ বলে সৈকতকে লেগ বিফোর আউট দিয়েছিলেন আম্পায়ার। এডিআরএস নিয়ে নিজের উইকেট বাঁচান সৈকত। ঠিক পরের বলেই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে দিনটি যে আজ তার, সেটিই বুঝিয়ে দেন ২৮ বছর বয়সী এ ব্যাটার।
অপরপ্রান্তে গেইলকে রীতিমতো দর্শক বানিয়ে চালিয়ে খেলতে থাকেন সৈকত। মোস্তাফিজের করা চতুর্থ ওভারে হাঁকান তিনটি বাউন্ডারি। মইন আলির করা পাওয়ার প্লের শেষ ওভারের চতুর্থ বলে কাউ কর্নার দিয়ে নিজের প্রথম ছক্কা হাঁকান সৈকত। যা ছিল বিপিএলের চলতি আসরের ৪০০তম ছক্কা।
সৈকতের উত্তাল ব্যাটে পাওয়ার প্লে’তে ১ উইকেট হারিয়ে ৫১ রান করে ফেলে বরিশাল। যেখানে গেইলের অবদান ছিল ৭ বলে মাত্র ৪ রান। সপ্তম ওভারে আবার টানা তিন বাউন্ডারি হাঁকান সৈকত। আবু হায়দার রনির করা সেই ওভারে হাঁকানো দ্বিতীয় বাউন্ডারিতে নিজের ফিফটিও পূরণ করেন তিনি।
পঞ্চাশে পৌঁছতে সৈকত খেলেন মাত্র ২৬ বল। ইরফান শুক্কুরের পর দ্বিতীয় অনভিষিক্ত বাংলাদেশি হিসেবে বিপিএল ফাইনালে ফিফটির রেকর্ড গড়েন সৈকত। সাত ওভারেই ৬৫ রান তুলে নিজেদের জয়ের পথ সুগম করে রাখে বরিশাল। তবে পরের দুই ওভারে আসেনি খুব বেশি। অষ্টম ওভারে প্রথমবারের মতো আক্রমণে এসে মাত্র ৪ রান খরচ করেন তানভির ইসলাম।
শহিদুলের করা পরের ওভারে আসে ৬ রান। পরপর দুই ওভার রান কমিয়ে আনার পর দশম ওভারে সৈকত আলির মূল্যবান উইকেট তুলে নেন বাঁহাতি স্পিনার তানভির। ছয়ের আশায় ব্যাট ঘুরিয়ে সীমানার কাছে ধরা পড়েন ৩৪ বলে ৫৮ রান করা সৈকত। তার ইনিংসটি সাজানো ছিল ১১ চার ও ১ ছয়ের মারে। ইনিংসের দশ ওভার শেষে বরিশালের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২ উইকেটে ৮১ রান।
সৈকত ফেরার পর খোলস ছেড়ে বের হন গেইল। মইনের করা ১১তম ওভারের প্রথম বলেই ছক্কা মারেন এ ক্যারিবীয় দানব। তানভিরের করা পরের ওভারে আরও এক ছক্কার সঙ্গে হাঁকান বাউন্ডারিও। তবে গেইলকে বেশি দূর যেতে দেননি তারই স্বদেশি নারিন। লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ার আগে ৩১ বলে ১ চার ও ২ ছয়ের মারে ৩৩ রান করে ইউনিভার্স বস।
এরপর ফর্মে থাকা বরিশাল অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও আউট হয়ে যান অল্পতেই। মোস্তাফিজের দারুণ ক্যাচে সাজঘরে ফেরার আগে ৭ বলে ৭ রান করেন সাকিব। এরপর দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন নাজমুল হোসেন শান্ত ও নুরুল হাসান সোহান। শহিদুলের করা ১৭তম ওভারে ছক্কা হাঁকিয়ে রানের চাহিদাটা বলের চেয়ে কমে নামিয়ে নেন শান্ত।
কিন্তু সেই ওভারেই আরিফুল হকের সরাসরি থ্রোয়ে সাজঘরের পথ ধরতে হয়ে নুরুল হাসান সোহানকে। তিনি করেন ১৩ বলে ১৪ রান। লম্বা ডাইব দিয়েও ব্যাট মাটিতে ফেলতে না পারায় রানআউট হন সোহান। নিজের ওপর হতাশায় ব্যাট বাতাসে ছুড়ে মারে এ উইকেটরক্ষক ব্যাটার।
পরের ওভারের প্রথম বলে ডোয়াইন ব্রাভোকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে ম্যাচে নতুন মোড় আনেন ব্যাট হাতে তাণ্ডব চালানো নারিন। সেই ওভারে মাত্র ২ রান খরচ করে সমীকরণটা ১২ বলে ১৬ রানে রেখে যান তিনি। নিজের চার ওভারে মাত্র ১৫ রান খরচ করে ২ উইকেট নেন এ ক্যারিবীয় রহস্য স্পিনার। তার স্পেলে ডট বলই ছিল ১৬টি।
১৯তম ওভারটি করতে আসেন নিজের প্রথম তিন ওভারে ২৫ রান খরচ করা মোস্তাফিজ। তার ওভারের প্রথম বলটি ছিল ওয়াইড লাইনের কাছ দিয়ে স্লোয়ার, ব্যাটে-বলে করতে পারেননি শান্ত। পরের বলটিও ছিল স্লোয়ার, তবে ঠিক স্ট্যাম্প লাইন বরাবর। এবারও ব্যাটে-বলে হয়নি শান্তর, আঘাত হানে প্যাডে। লেগ বিফোরের সিদ্ধান্ত জানাতে কোনো সমস্যাই হয়নি আম্পায়ারের।
উইকেটে এসে পরের বলটি উড়িয়ে মারেন মুজিব উর রহমান। ওয়াইড লং অন থেকে নিয়ে নেন ২ রান। পরের বলে আসে ১ রান। সমীকরণ তখন ৮ বলে ১৩ রান। কাউ কর্নার দিয়ে ২ রান নিয়ে নেন তৌহিদ হৃদয়। ওভারের শেষ বলে লেগ বাই থেকে আসে আরও ১ রান। মোস্তাফিজের এই দুর্দান্ত ওভার শেষে বাকি থাকে ৬ বলে ১০ রান।
শেষ ওভারে ১০ রান ঠেকিয়ে কুমিল্লাকে চ্যাম্পিয়ন করার দায়িত্বটা পড়ে শহিদুলের কাঁধে। প্রথম বল সোজা বোলারের হাতেই খেলেন তৌহিদ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলে সুইপার কভার থেকে আসে ১টি করে রান। পরের বল লেগস্ট্যাম্পের বাইরে ওয়াইড করে বসেন শহিদুল। সেটিতে আবার কট বিহাইন্ডের আবেদন করে কুমিল্লা।
আম্পায়ার ওয়াইড সিগনাল এডিআরএস নেয় তারা। থার্ড আম্পায়ার অনেক সময় নিয়ে শেষ পর্যন্ত নটআউটের সিদ্ধান্ত জানান। বরিশাল ডাগআউট থেকে সীমানা দড়ির কাছে চলে এসেছিলেন বরিশাল কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন ও অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। নট আউটের সিদ্ধান্তে স্বস্তি ফেরে তাদের মধ্যে।
ওভারের চতুর্থ বলে লং অনে মেরে দ্রুত দুই রান নিয়ে নেন তৌহিদ। ফলে শেষ ২ বলে বাকি থাকে ৫ রান। পঞ্চম বলে বড় শট খেলতে গিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তৌহিদ। কিন্তু ডিপ স্কয়ার লেগে দাঁড়িয়ে সেটি তালুবন্দী করতে পারেননি তানভির। ফলে শেষ বলে সমীকরণ দাঁড়ায় ৩ রানের।
অফস্ট্যাম্পের বাইরের ফুল লেন্থের ডেলিভারিটি এক্সট্রা কভার দিয়ে সোজা ইমরুলের হাতে খেলেন তৌহিদ। সেই বলে আসে মাত্র ১ রান। ইমরুলের থ্রোয়ে লিটন দাস উইকেট ভাঙতেই ১ রানের জয়ে শিরোপা উল্লাসে মেতে ওঠে পুরো কুমিল্লা শিবির। আনন্দের আতিশয্যে নিজের জার্সি খুলে উদযাপন করেন অধিনায়ক ইমরুল।
এর আগে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কুমিল্লা। তাদেরকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেওয়ার দায়িত্বটা বেশ ভালোভাবেই পালন করেছেন নারিন। পাওয়ার প্লে’র পূর্ণ সুবিধা নিয়ে মাত্র ২১ বলে ফিফটি করেছেন তিনি।
পুরো আসরে ওভারপ্রতি ছয়েরও কম রান খরচ করেছিলেন ফরচুন বরিশালের আফগান রহস্য স্পিনার মুজিব উর রহমান। কিন্তু আজকের ম্যাচে তাকে তুলোধুনোই করলেন নারিন। মুজিবের করা ইনিংসের প্রথম ওভারেই দুই ছক্কা ও এক চারের মারে ১৮ রান তুলে নেন এ বাঁহাতি ব্যাটার।
এরপর শফিকুল ইসলামের পরের ওভারেও হাঁকান দুই ছক্কা ও এক চার। পরের দুই ওভারে তেমন রান আসেনি। তবে সাকিব আল হাসানের করা পঞ্চম ওভারে তিনটি বাউন্ডারির পর শেষ বলে তিন রান নিয়ে ব্যাক টু ব্যাক ফিফটি হাঁকান নারিন। আজকের ফিফটি করতে তিনি খেলেন ২১ বল।
পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে নারিনের বিদায়ঘণ্টা বাজান মেহেদি হাসান রানা। সেই ওভারেও প্রথম বলে ছক্কা হাঁকান নারিন। পরের বলে আবারও ছক্কা মারতে গিয়ে লং অনে ধরা পড়েন নাজমুল হোসেন শান্তর হাতে। আউট হওয়ার আগে ৫টি করে চার-ছয়ের মারে ২৩ বলে ৫৭ রানের ইনিংস খেলেন নারিন।
এই নারিন শোয়ের মাঝেই মাত্র ৪ রান করে আউট হন আরেক ওপেনার লিটন দাস। সাকিবের প্রথম ও ইনিংসের তৃতীয় ওভারের শেষ বলে আর্ম ডেলিভারিতে সরাসরি বোল্ড হয়ে যান ৬ বলে ৪ রান করা এ উইকেটরক্ষক ব্যাটার। আর নারিনের বিদায়ের পর কুমিল্লাকে পুরোপুরি চেপে ধরে বরিশালের বোলাররা।
পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে ৭৩ রান করে ফেলেছিল কুমিল্লা। কিন্তু পরের ৬ ওভারে আসে মাত্র ২৭ রান, সাজঘরে ফিরে যান চার ব্যাটার। সপ্তম ওভারে ফাফ ডু প্লেসির সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে রানআউট হন ৭ বলে ৮ রান করা মাহমুদুল হাসান জয়। এক ওভার পর মুজিবকে ফিরতি ক্যাচ দেন ৭ বলে ৪ রান করা ডু প্লেসি।
পরের ওভারে সাজঘরের পথ ধরেন ইমরুল কায়েসও। ডোয়াইন ব্রাভোর শর্ট পিচ ডেলিভারিতে পুল করতে গিয়ে গতি ও বাউন্সের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি ইমরুল। তার ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে বল চলে যায় উইকেটরক্ষক নুরুল হাসান সোহানের গ্লাভসে।কুমিল্লার অধিনায়কের ব্যাট থেকে আসে ১২ রান।
মাত্র ১০ ওভারের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় কুমিল্লা। তাদের বিপদ আরও বাড়ে ১১তম ওভারে আরিফুল হকও সাজঘরের পথ ধরলে। মুজিবের ভেতরে ঢোকা ডেলিভারিতে সোজা বোল্ড হওয়ার আগে রানের খাতা খুলতে পারেননি আরিফুল। মাত্র ৫ ওভারের মধ্যে ঝড়ো সূচনা থেকে আকস্মিক বিপর্যয় দেখে ফেলে কুমিল্লা।
এরপর সপ্তম উইকেট জুটিতে দলকে লড়াই করার মতো পুঁজি এনে দেন ইংলিশ অলরাউন্ডার মইন আলি ও আবু হায়দার রনি। এ দুজনের ৮.৪ ওভারের জুটিতে আসে ৫৪ রান। শফিকুলের করা ইনিংসের শেষ ওভারের প্রথম বলে রান আউট হওয়ার আগে ৩২ বলে ৩৮ রান করেন মইন।
একই ওভারের তৃতীয় বলে শফিকুলের বাউন্সারে সাজঘরে ফেরেন আবু হায়দার রনি। এ ডানহাতি ব্যাটার ২৭ বল খেলে করেন ১৯ রান। পরের বলেই আপার কাট করতে গিয়ে থার্ডম্যানে ধরা পড়েন শহিদুল ইসলাম। ইনিংসের শেষ দুই বলে আসে আর মাত্র ১ রান, তাও বাই থেকে। কুমিল্লার ইনিংস থামে ১৫১ রানে।
সবমিলিয়ে ইনিংসের শেষ ওভারে মাত্র ১ রান খরচ করে দুই উইকেট নেন শফিকুল। নিজের ৪ ওভারে ৩১ রান খরচ করেন শফিকুল। এছাড়া মুজিব ৪ ওভারে ২৭ রান খরচায় ২ উইকেট নেন। সাকিব, ব্রাভো ও মেহেদি রানার শিকার ১টি করে উইকেট।