Current Date:Sep 30, 2024

সেই বাংলাদেশি নাগরিককে হস্তান্তরে ভারতের উদ্যোগ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিচারাধীন বা দন্ডপ্রাপ্ত বন্দি বিনিময় চুক্তি অনুযায়ী দিল্লির তিহার জেলে আটক সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফরাজিকে বাংলাদেশে হস্তান্তরের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ডাকাতি ও খুনের ঘটনায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এই বাংলাদেশি অপরাধীর বয়স ও প্রোফাইল (কারাগারে থাকাকালীন সময়ে তার সংযত ও ভাল ব্যবহার) খতিয়ে দেখেই তাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ-মিয়ানমার বিভাগের যুগ্ম সচিব শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথন।

এক বিবৃতিতে শ্রীপ্রিয়া জানান ‘ডাকাতি ও খুনের মতো জঘন্য অপরাধের জন্য ভারতীয় আদালত ফারাজিকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও দিল্লি হাইকোর্ট-উভয়ই ফারাজির আর্জি খারিজ করে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও অপরাধীর বয়স ও প্রোফাইল খতিয়ে দেখে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি বিনিময় চুক্তির অধীনে ফারাজিকে আমরা বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে সম্মত হয়েছি। আমরা বাদল ফারাজির নাগরিকত্ব প্রমাণে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম এবং চুক্তির বিধান অনুযায়ী ফারাজিকে বাংলাদেশের হাতে হস্তান্তরের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক অনুরোধও জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের তরফেও আমাদের কাছে ফারাজির শুনানি ও দণ্ডাদেশ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য চেয়ে পাঠানো হয় যাতে এই বিষয়টিতে গতি আসে। আমরাও এসম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে তা সরবরাহের জন্য নিয়মিত ভাবে ভারতের সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলির সাথে সমন্বয় রেখে চলেছি। আমরা আশাবাদী খুব শিগগিরি বাংলাদেশি বন্দি বাদল ফারাজিকে হস্তান্তর করতে সক্ষম হবো’।

বাদলের মুক্তির ব্যাপারে গত কয়েকমাস ধরেই ভারত জুড়ে শান্তিপূর্ণ র‌্যালি, জমায়েত, মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। বিষয়টিতে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গত মার্চে দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে এক শান্তিপূর্ণ জমায়েতের আয়োজন করেন সমাজসেবী ভারতের উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা রাহুল কাপুর। ওই র‌্যালিতেও শতাধিক মানুষের জমায়েত হয়।

বাদলকে দ্রুত কারাগার মুক্ত গত দুই বছর ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন রাহুল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল ওয়ার্কে মার্স্টাস করা রাহুল সামাজিক কাজের জন্য ২০১৬ সাল থেকে তিহার জেলে যাতায়াত করছেন। কারাগারের বন্দিদের পুনর্বাসন, তাদের কাউন্সেলিং-এর কাজ করতে করতেই বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফারাজি’র সাথে পরিচয় হয় রাহুলের। বাদলের মুখ থেকে সবকিছু শুনে নতুন লড়াই শুরু হয় রাহুলের। দিল্লির কারাগার থেকে বাদলকে মুক্তি করতে, বাদলের ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দেশ ভুলে সম্মিলিত ভাবে অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করার আর্জি জানান রাহুল। এতে ভাল সাড়াও মেলে। ইতিমধ্যেই ‘জাস্টিস ফর বাদল’-শীর্ষক ওই পিটিশনে বাদলের মুক্তি চেয়ে ২৭০০ জনের বেশি মানুষ স্বাক্ষর করে ফেলেছেন। এর পাশাপাশি বাদলের মুক্তির বিষয়ে তিনি যোগাযোগ করেছেন দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সাথে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-কেও চিঠি লিখে বাদলের মুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি আনতে উদ্যোগী হয়েছেন রাহুল। বাদলের পাশে দাঁড়াতে গত কয়েক মাস ধরেই ফেসবুকেও লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন রাহুল। সম্প্রতি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টিও আকর্ষণ করেন রাহুল। এরপরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যুগ্ম সচিব শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথনের স্বাক্ষর করা একটি চিঠি এসে পৌঁছয় রাহুল কাপুরের কাছে। ওই বিবৃতিতেই বাদলের হস্তান্তরের বিষয়ে দুই দেশের উদ্যোগের বিষয়টি জানানো হয়।

বাদলের হস্তান্তরের বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে রাহুল কাপুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান ‘বাদলের অল্প বয়স ও কারাগারের মধ্যে তার ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনা করে তাকে যেন মুক্তি দেওয়ার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আর্জি জানানো হয়েছিল। অবশেষে মন্ত্রণালয় তাতে সাড়া দিয়েছে’। বাদলকে বাংলাদেশের বিমানে উঠিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমার লড়াই চালু থাকবে বলেও জানান রাহুল কাপুর।

এদিকে ছেলে বাদলের মুক্তির পথ চেয়ে বসে আছেন তার। ছেলের দ্রুত মুক্তির জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, দেশটির সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আর্জি জানিয়েছেন বাদলের অসুস্থ মা। ফেসবুকের মাধ্যমে তার আর্জি মৃত্যুর আগে তিনি ছেলের মুখ দেখে যেতে পারেন। ছেলেকে মুক্ত করতে নানা চেষ্টায় ব্যর্থ বাদলের বাবা আবদুল খালেক ফরাজি আগেই পরলোক গমন করেছেন।

উল্লেখ্য তাজমহল দেখতে এসে দশ বছর ধরে তিহার জেলে বন্দি রয়েছেন বাংলাদেশের মংলার বাদল ফারাজি। ২০০৮ সালের ১৩ জুলাই, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত পনেরো বছরের কিশোর বাদল। বন্ধুদের কাছে শুনে তাজমহল দেখতে লুকিয়ে ভারতে রওনা দেয় সে। কিন্তু বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের পেট্রাপোল আন্তর্জাতিক সীমান্তে প্রবেশের পরই হত্যা মামলার আসামি হিসাবে তাকে আটক করে বিএসএফ। ২০০৮ সালে মে মাসে দিল্লির ওমর কলোনিতে বৃদ্ধা খুনের সাথে জড়িত থাকার অভিযাগ ওঠে বাদল সিং নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু শুধুমাত্র নামের মিল থাকার কারণেই বাংলাদেশি বাদলকে ওই খুনের মামলায় আটক করা হয় বলে অভিযোগ।

২০১৫ সালের ৭ আস্টি বাদলকে দোষী সাব্যস্ত করে দিল্লির সাকেট আদালত, বাদলকে যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে দিল্লি হাইকোর্টও নিম্ন আদালতের সেই রায় বহাল রাখে। পরে তার স্থান হয় দিল্লির তিহার কারাগারে। যদিও গত একবছর ধরে তিহার জেল থেকে দিল্লির মান্ডোলি কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয় বাদলকে। কিন্তু বিনা দোষে এই সাজা কোনভাবেই মেনে নেয়নি বাদল। দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় হাইকোর্টের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন বাদল। কিন্তু শীর্ষ আদালতও বাদলের আর্জি খারিজ করে দেয়। ফলে গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারেই কাটাতে হচ্ছে বাদলকে।

Share