নিউজ ডেস্ক : বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে মহাকাশে খুলে দেয়া বিপুল সম্ভাবনার অংশীদার হয়ে উঠলো বাংলাদেশ। স্যাটেলাইটটি একাধারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এবং সম্প্রচার শিল্পের পাশাপাশি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেছেন, স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের মাধ্যমে দেশের দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেট ও টেলিকমিউনিকেশন সুবিধার আওতায় আসবে।
মহাকাশের ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমায় অবস্থান করে উপগ্রহটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়-আবহাওয়া পূর্বাভাস ও পর্যবেক্ষণে দেশের সক্ষমতা সম্প্রসারিত করবে।
বাংলাদেশে অপ্রত্যাশিত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বর্তমান টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা যদি কখনও ভেঙ্গে পড়ে তখন গোটা দেশব্যাপী এই যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরবিচ্ছিন্নভাবে সচল রাখা নিশ্চিত করতে স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, একটি যোগাযোগ স্যাটেলাইট থেকে তিন ধরনের সেবা পাওয়া যায়— ১. সম্প্রচার, ২. টেলিযোগাযোগ ও ৩. ডাটা কমিউনিকেশনস।
তিনি বলেন, দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে সরাসরি পৌঁছাতে টেলিভিশন এবং রেডিও স্টেশনগুলো ব্রডকাস্টিং সেবা ব্যবহার করে থাকে। ইন্টারনেট সেবা সরবরাহকারীরা আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) ইন্টারনেট সেবা দিতে স্যাটেলাইট ব্যবহার করেন। সেল ফোন এবং ল্যান্ড ফোন অপারেটররা তাদের সাবস্ক্রাইবারদের সঙ্গে সংযোগ তৈরির জন্য স্যাটেলাইটের টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহার করতে পারেন।
বর্তমানে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলো তাদের সম্প্রচারের জন্য বিদেশি মালিকানাধীন স্যাটেলাইটের ওপরে নির্ভরশীল। বঙ্গবন্ধু-১ স্যালেটলাইট এই বিদেশ নির্ভরতা কমাবে এবং আমাদেরকে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ে সহায়তা করবে।
এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃত্রিম উপগ্রহের অধিকারী বিশ্বের ৫৭তম দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৩০টির বেশি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইট ভাড়ায় ব্যবহার করছে। এতে বছরে ব্যয় হবে প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার।
প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার এই স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২০টি ভাড়ার জন্য রাখা হয়েছে।ফলে উপগ্রহটি থেকে সার্ক দেশগুলোর পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজাকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কিস্তান ও কাজাকিস্তানে ভাড়া দেয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে।
কর্মকর্তারা জানান,নবগঠিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল) ইতোমধ্যেই ট্রান্সপন্ডার ভাড়ার জন্য ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।
তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জানান, এর মাধ্যমে শুধু বৈদেশিক মুদ্রারই সাশ্রয় হবে না, সেই সঙ্গে অব্যবহৃত অংশ নেপাল, ভুটানের মতো দেশে ভাড়া দিয়ে প্রতি বছর আয় হবে প্রায় ৫ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকারও বেশি।
সে হিসেবে ৭ বছরে খরচ উঠে আসবে।
ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের অপর একটি পণ্য উল্লেখ করে বিটিআরসি বলেছে, ৪০টি ট্রান্সপন্ডারে মোট এক হাজার ৬০০ এমএইচজেড ফ্রিকুয়েন্সি রয়েছে।
তবে বাংলাদেশি স্যাটেলাইট টেলিভিশনগুলোর এক শঙ্কা ছিল, বঙ্গবন্ধু-১ এর অবস্থান হয়তো তাদের সম্প্রচারে কিছু সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ জানান, এখন তারা অন্য স্যাটেলাইটের সহযোগিতায় সহজেই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
বর্তমানে বাংলাদেশের সকল বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের সম্প্রচারের জন্য এ্যাস্টার-৭ ব্যবহার করছে, যা ৭৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি পূর্বে। শুধু রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) তাদের সম্প্রচার এশিয়াস্যাট-৭ থেকে সম্প্রচার কার্যক্রম চালায়, যা ১০৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি পূর্বে।
ক্যাবল টেলিভিশন সার্ভিস প্রোভাইডারদের বিকল্প হিসেবে ডাইরেক্ট-টু-হোম (ডিটিএইচ) তখন স্যাটেলাইটের অন্যতম প্রধান গ্রাহক হবে।
ডিটিএইচ সেবা বিশ্বব্যাপী টেলিভিশন বিনোদনের জগতে দ্রুত গতির সেবা দিয়ে থাকে এবং এখন বঙ্গবন্ধু-১ এর মাধ্যমে এই সেবা আরও সহজ ও দ্রুততর করবে। স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে ভিডিও তথা সম্প্রচার সহজ করার পাশাপাশি অনুষ্ঠান কার্যক্রম ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক এবং ডিটিএইচের মাধ্যমে অনায়াসে বিতরণ করতে পারবে
এ ছাড়া ভিডিও সার্ভিস, ই-লার্নিং, টেলি-মেডিসিন, পরিবার পরিকল্পনা, কৃষি খাতসহ দুর্যোগ উদ্ধারে ভয়েস সার্ভিসের জন্য সেলুলার নেটয়ার্কের কার্যক্রম এবং এসসিএডিএ, এওএইচও এর ডাটা সার্ভিসের পাশাপাশি বিজনেস-টু-বিজনেস (ভিস্যাট) পরিচালনায় আরও সহজতর করবে।
স্যাটেলাইটে নিজস্ব ভিস্যাট থাকবে যার মাধ্যমে ব্যাংক ও অন্যান্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভয়েস, ডাটা ও ইন্টারনেট সেবা নিতে পারবে।
বিটিআরসি ২০১৫ সালের নভেম্বরে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট নির্মাণের জন্য ফ্রান্সের থালেস অ্যালিনিয়া স্পেস ফ্যাসিলিটিস কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য স্পেস এক্স এর ফেলকন-৯ লঞ্চার ব্যবহার করা হবে।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়ার স্যাটেলাইট প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারস্পুটনিক’ এর কাছ থেকে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলারে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমায় (স্লট) কক্ষপথ স্লট কিনে।