ডেস্ক রিপোর্ট : ভোটের বাকি আর মাত্র দুই দিন। দিনরাত এক করে প্রচারণা চালাচ্ছেন খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ নির্বাচনের একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে প্রার্থীদের ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনার মূল বিষয় হয়ে উঠেছে পুলিশের অভিযান। খুলনা মহানগর ও জেলা পুলিশ গত দুই সপ্তাহে বিএনপির ১০৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।
বিএনপি অভিযোগ করেছে, এত দিন পুলিশ রাতে দলের কর্মীদের বাড়ি বাড়ি অভিযান চালাত, এখন দিনেও গ্রেপ্তার করছে। এমনকি মেয়র প্রার্থী গণসংযোগ করার সময়ও লোকজন ধরে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
নেতা-কর্মীদের দৌড়ের ওপর রাখার পাশাপাশি পুলিশের বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ উঠেছে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ফোন করার। ভোটের দিন বিভিন্ন কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করবেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নানা বিষয় তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের নিজের বা পরিবারের কারও অতীত বা বর্তমান রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা জানতে চাইছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সাদাপোশাকের পুলিশ সদস্যরা কারও কারও বাড়ি গিয়েও খোঁজখবর করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে গতকাল যোগাযোগ করা হলে খুলনা মহানগর পুলিশ (কেএমপি) কমিশনার মো. হুমায়ুন কবির কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বিষয়টি নিয়ে পুলিশের মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
কেএমপির মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) সোনালী সেন প্রথম আলোকে বলেন, এটা পুলিশের আওতার মধ্যে নয়। পুলিশ কেন তাঁদের খোঁজ নেবে? প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কোনো তালিকা পুলিশের কাছে নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
তবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র জানায়, ২৮৯ জন প্রিসাইডিং অফিসারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাঁদের সবার নাম, ফোন নম্বরসহ তালিকা আরও আগে পুলিশকে যাচাই-বাছাই করার জন্য দেওয়া হয়েছে। এরপর দু-একজনকে পরিবর্তনও করা হয়েছে।
বিএনপির মেয়র প্রার্থীও রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রিসাইডিং অফিসারদের ফোন করা এবং চাপ দেওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ না দিতে বিএনপির পক্ষ থেকে ইসিকে অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ইউনুচ আলী গতকাল বলেন, বিএনপির মেয়র প্রাথী নজরুল ইসলাম মঞ্জু অভিযোগ করেছেন যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই সব শিক্ষক প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন বলে তাঁদের আশঙ্কা। ইসি সেটা বিবেচনায় নিয়েছে।
এদিকে গতকাল দুপুরের পর বিএনপির মেয়র প্রার্থী গণসংযোগ চালানোর সময় শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাস্তুহারা কলোনি এলাকা থেকে তাঁর এক কর্মী মনোয়ার হোসেনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। এ ছাড়া দুপুরে নগরের ব্যস্ততম রয়েল মোড় থেকে মনিরুজ্জামান, মেহেদী হাসানসহ তিনজনকে পুলিশ আটক করে। তাঁরা সাতক্ষীরা বিএনপির নেতা-কর্মী। দলীয় প্রাথীর পক্ষে প্রচার চালাতে শহরে এসেছিলেন। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর মিছিল শেষ করার পরপর তিনজন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
নজরুল ইসলামের অভিযোগ, ‘যেখানেই নির্বাচনী গণসংযোগ করি, সেখানেই পুলিশ হাজির হয়ে যায়। নাম নোট করে ছবি তোলে নেতা-কর্মীদের।’ তিনি আরও বলেন, বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত তাঁকে থানায় থানায় ঘুরতে হয়েছে। ওই দিন ১৭ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার এবং পাঁচ শতাধিক বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো হয়।
বিএনপির অভিযোগ, মহানগরের বাইরে জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। তাঁরা দিনের বেলায় নগরে এসে প্রচারে অংশ নেন। সন্ধ্যায় বা রাতে বাড়ি ফেরার পর বা পথে গ্রেপ্তার হচ্ছেন তাঁরা। এ পর্যন্ত বিভিন্ন উপজেলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫৫ জন।
এমনকি ইসির নির্দেশনা পুলিশ পুরোপুরি মানছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা হচ্ছে, তফসিল ঘোষণার পর নতুন কোনো মামলা দিয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। কিন্তু এর মধ্যে নতুন মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করার ঘটনা ঘটেছে।
এ ছাড়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলার এজাহারভুক্ত বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি ছাড়া অন্যদের গ্রেপ্তার না করারও নির্দেশনা আছে। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের বড় অংশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি নন বলে বিএনপির আইনজীবীরা জানান। বিভিন্ন মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামির কোটায়ও অনেককে ধরা হচ্ছে।
তবে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র সোনালী সেন বলেন, তফসিল ঘোষণার পর কোনো মামলা হয়নি। তবে কিছুদিন আগে খালিশপুর থানার ওসিকে মারধরের ঘটনায় ওই থানায় একটি মামলায় দুজন গ্রেপ্তার হন। আর যাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাঁরা সবাই আগের মামলার আসামি।
অন্য দলের কেউ গ্রেপ্তার হচ্ছেন কি না, জানতে চাইলে সোনালী সেন বলেন, কোনো দল যাচাই-বাছাই করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তবে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বিএনপিসহ অন্য দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা আছেন।
নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে ইসি পুলিশের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিভাগীয় সমন্বয় কমিটির সভায় নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এ বিষয়ে জানতে চান। জবাবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আসামিদের ধরা হচ্ছে।
মাহবুব তালুকদার গতকাল বলেন, কমিশনের স্পষ্ট বার্তা ছিল, তফসিলের পর নতুন কোনো মামলা দিয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। সংবিধান অনুযায়ী কমিশন দায়িত্ব পালন করে যাবে। সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। নির্বাচন বিতর্কিত হতে দেবে না কমিশন।
তবে তফসিল ঘোষণার পর নতুন মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার এবং এজাহারভুক্ত আসামি না হওয়া সত্ত্বেও গ্রেপ্তারের নজির রয়েছে। এর মধ্যে খালিশপুর থানায় গত সপ্তাহে পুলিশ নতুন মামলা করেছে দুটি। একটি মামলা হয়েছে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে, সেটিতে বিএনপির আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হয় খালিশপুর থানার ওসির ওপর হামলার অভিযোগে।
অন্য মেয়র প্রার্থীদের ভাবনা
বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়কে ভালো চোখে দেখছেন না সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ বাদে অন্য তিন প্রার্থী। তাঁরা মনে করেন, এতে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে। ভোটারদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
তবে আওয়ামী লীগ ধরপাকড়কে নির্বাচন সুষ্ঠু করার পথ হিসেবে দেখছে। দলটির খুলনা সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক এস এম কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও যাঁদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা আছে, পুলিশ ওই সব আসামিকে গ্রেপ্তার করছে নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে। খুলনায় উৎসবের আমেজ। বিএনপি প্রার্থীও মিছিল করছেন, প্রচারণা চালাচ্ছেন।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কেউ নেই কেন, এ প্রশ্নের কামাল হোসেন বলেন, দল ৯ বছর ক্ষমতায় থাকলেও নেতা-কর্মীরা কোথাও বোমা মারেননি, গাড়িতে আগুন জ্বালাননি। তাঁদের নামে এ ধরনের কোনো মামলাও নেই। কে কোথায় কী করেন, এটা জানার পরই পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
সিপিবির প্রার্থী মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থায় ধরপাকড় নতুন নয়। এই কাজগুলো আগে বিএনপি করেছে আর এখন আওয়ামী লীগ করছে। ক্ষমতাসীন দলকে সন্তুষ্ট করার জন্য এসব ধরপাকড় করা হচ্ছে।
জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী শফিকুর রহমান বলেন, যাঁদের নামে মামলা আছে, শুধু তাঁদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে শুনেছেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র পদপ্রার্থী মুজ্জাম্মিল হক বলেন, ধরপাকড়ে নির্বাচনের পরিবেশ কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। ভোটাররা ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন আছে, আশঙ্কা আছে। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ, জল্পনা-কল্পনা দিন দিন বাড়ছে।