অনলাইন ডেস্ক : বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত (মান্থলি পে-অর্ডার) শিক্ষকদের পবিত্র ঈদ উপলক্ষে বোনাস হিসেবে মূল বেতনের ২৫ শতাংশ প্রদান করা হয়। আর কর্মচারীদের ৫০ শতাংশ দেয়া হয়। দুই ঈদে শিক্ষক-কর্মচারীরা এ বোনাস পেয়ে থাকেন। ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, বাড়ি ভাড়া ১৫ শ’ টাকা দেয়া হয়। এ ছাড়া ২০১৫ সাল থেকে চালু করা বৈশাখী ভাতাসহ সরকারি স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের মতো সব ভাতা দেয়ার দাবি করছেন বেসরকারি শিক্ষকেরা।
এ দাবি নিয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের সব অংশ ও মতের শিক্ষক সংগঠনগুলো একাট্টা। এ দাবি আদায়ে এখন পর্যন্ত শিক্ষক সংগঠনগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে নানা কর্মসূচি পালন করে তবে কখনোই এক মঞ্চে এসে এ দাবি তুলে ধরতে পারেনি। শিক্ষক সংগঠনগুলো এসব ভাতা ও বোনাসের জন্য সরকারের কত টাকার প্রয়োজন পড়বে, তার কোনো পরিসংখ্যান-হিসাব শিক্ষক সংগঠনগুলোর অধিকাংশ নেতারও জানা নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বর্তমান সরকার সমর্থক প্রবীণ এক শিক্ষক নেতা নয়া দিগন্তকে বলেন, শিক্ষক নেতারা এখন নিজ সংগঠন ও পদ পদবি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তারা শিক্ষকদের স্বার্থের দিকটি আগের মতো গুরুত্ব দেন না। সরকারের আমলারা যেসব তথ্য দিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করেন, তার বিপরীতে সঠিক তথ্য-উপাত্ত কোনো শিক্ষক নেতা এখন দিতে পারেন না। তাই শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিও এখন আর নীতিনির্ধারকরা স্বপ্রণোদিত না হলে, আদায় বা মেনে নেন না। শিক্ষক নেতাদের কাছে এখন কোন আপডেট তথ্য-উপাত্ত থাকে না। শিক্ষক নেতারাও এখন এ সব বিষয় নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না। তিনি আরো বলেন, এ সব কারণেই শিক্ষকদের আন্দোলন এখন শিক্ষকদের স্বার্থের চেয়ে নেতাদের পদ-পদবি ও সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি এবং দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
যদিও দেশে মাধ্যমিক শিক্ষার ৯৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত হয়ে থাকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। মাত্র তিন-চার শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষা পরিচালনা করে সরকার বা বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি বেতন স্কেল অনুসারে বেতনসহ অন্যান্য সব ভাতা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। বিপরীতে বেসরকারি শিক্ষকদের মাত্র একটি অংশ সরকারি বেতন ভাতা পেয়ে থাকেন। সারা দেশে এ সংখ্যা হচ্ছে প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ। অথচ সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষকদের সংখ্যা হচ্ছে ১০ লক্ষাধিক। পরিসংখ্যানটি বেনবেইজের।
এত বিপুল পরিমাণ শিক্ষকেরা নামমাত্র বেতনভাতা পেয়ে থাকেন নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে। তাও আবার রাজধানী কেন্দ্রিক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এবং অনেক জেলা শহরের বেসরকারি শিক্ষকেরা নিয়মিত ও চাহিদা-যোগ্যতার নিরীখে বেতনভাতা পান না। অথচ বেসরকারি শিক্ষকেরাই দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা টিকিয়ে রেখেছেন।
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার মান বিচারের সব ক’টি সূচকের বিবেচনায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিই শীর্ষে। পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, শিক্ষার্থীদের জিপিএ-এর মান, পাসের হার সব ক’টি দিকেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ছাপিয়ে সরকারি স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা কখনোই শীর্ষে যেতে পারেনি। অথচ সরকার ও নীতিনির্ধারকেরা সব সময়ই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে আকাশ-পাতাল বেতন-ভাতার বৈষম্য রেখে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন সব ক’টি শিক্ষক সংগঠনের নেতারা। তারা বলেন, সরকারকেই এ বৈষম্যের অবসান করতে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার এবং বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ মাজহারুল হান্নান বলেন, বৈষম্য বিভাজন করে কখনোই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত হবে না। আর বিলম্ব না করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা চালু করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। তিনি বলেন, এ সরকারের কাছে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন তো সব সময়ই গৌণ।
বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম বৃহৎ সংগঠন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো: সেলিম ভূঁইয়া এ ব্যাপারে বলেন, শিক্ষায় এখন যে নৈরাজ্য চলছে, তা দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা তো দূরের কথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনাই দুরূহ হয়ে পড়ছে। বৈষম্য সৃষ্টি এবং বিমাতাসূলভ আচরণ করছে সরকার। সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। শিক্ষকদের বঞ্চিত করে, কখনোই মানসম্পন্ন শিক্ষা আশা করাটাই দুরাশা। তিনি অবিলম্বে মাধ্যমিক স্তরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি করেন। বিচ্ছিন্নভাবে সরকারিকরণের ফলে বৈষম্য আরো প্রকট হচ্ছে, যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে, রাজনৈতিক বিবেচনায় এখন জাতীয়করণ করার ফলে, সরকারের বিরুদ্ধে শুধু শিক্ষকেরাই নয়, সংশ্লিষ্ট এলকার জনগণও ক্ষুব্ধ হচ্ছে।
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্যসচিব ও সরকার সমর্থক শিক্ষক সংগঠনের শীর্ষ নেতা অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু গতকাল বলেন, বেসরকারি শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতার দাবি দীর্ঘ দিনের। পবিত্র ঈদ উৎসব সবার। শুধু সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদেরই শুধু নয়, যে তারা শতভাগ উৎসব ভাতা ও বোনাস পাবেন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের ঈদ উৎসব থাকে। তাতে তারা যদি আনন্দ উপভোগ থেকে বঞ্চিত হন, তাতে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। শতভাগ বোনাস ও ভাতা দিতে সরকারের কত টাকার সংশ্লেষ হতে পারে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, এ মুহূর্তে সঠিক পরিসংখ্যানটি বলতে পারছি না, তবে, ২৫ শতাংশ ও ৫০শতাংশে ১৮৬ কোটি হলে, সম্ভাব্য ৫ শ’ কোটির মত প্রয়োজন হতে পারে।
বেসরকারি শিক্ষক সমিতির একাংশের সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, শতভাগ উৎসব ভাতা না দিয়ে সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে।