Current Date:Nov 25, 2024

লন্ডনে গানে গানে যাযাবর চিরকুট

বিনোদন ডেস্ক : যুক্তরাজ্যে দশ দিনের একটা সুন্দর ও সফল সফর শেষে গত সপ্তাহে দেশে ফিরলাম আমরা। লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আমন্ত্রণে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় আয়োজন বৈশাখী মেলায় গান শোনাতে গত ২৮ জুন লন্ডনে যাই। বিশ্ব সংগীত, ক্রীড়া, শিল্প-সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এ জায়গাটায় এটা আমাদের প্রথম যাওয়া। তাই ভালো লাগাটাও ছিল অন্য রকম। সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের সবার হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা, আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়েছি বারবার। মুগ্ধ হয়েছি সেখানকার হাজার বছরের ঐতিহ্য, প্রাচীনতম স্থাপত্য আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে। মুগ্ধতার সেসব স্মৃতি মাথায় ঘুরছে এখনো।

কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ২৯ তারিখে বিবিসির সদর দপ্তরে এশিয়ান নেটওয়ার্কের জনপ্রিয় মর্নিং শোতে সাক্ষাৎকার দিয়েই বেরিয়ে পড়ি আশপাশ ঘুরে দেখতে। আমাদের চির যাযাবর মন চার দেয়ালে আটকে সময় নষ্ট করতে চায় না যেন। লন্ডনে এখন গ্রীষ্মকাল চলছে। দারুণ সুন্দর আবহাওয়া। প্রথম দিনেই লন্ডনের বিশেষ বিশেষ দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখে ফেললাম এক নিঃশ্বাসে। প্রথমে গেলাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রানি; কুইন এলিজাবেথের বাড়ি বাকিংহাম প্যালেসে। সেখানে যেতেই দেখি হঠাৎ তোড়জোড়। নিরাপত্তা প্রহরীরা হঠাৎ তৎপর হয়ে উঠল। জড়ো হওয়া হাজার হাজার মানুষের ভেতরে সেকি উত্তেজনা। জিজ্ঞেস করতেই একজন জানাল, রানি বাইরে থেকে আসছেন। তাই এই তোড়জোড়। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ পরে জানলাম রানি আসবেন না। পরে জানলাম, প্রাসাদের প্রহরী পরিবর্তনের সেশন ছিল এটা। যখনই সেখানে প্রহরী পরিবর্তন হয়, তখনই এই বিশেষ সেলিব্রেশন চলে। সবাই বলছিল তোমরা খুবই ভাগ্যবান, এসেই এটা দেখতে পেলে।

এরপর আমরা গেলাম ১৩ শ শতকের নিদর্শন ট্রাফালগার স্কয়ারে। প্রতিবছর ইংরেজি নববর্ষের বড় উৎসবটা এখানে হয়। শত শত বছর ধরে যেকোনো দাবি-দাওয়া জানাতে মানুষের জড়ো হওয়ার জন্য বিখ্যাত এই জায়গাটা। সেখানে ঝরনা, সুন্দর সব স্থাপত্য দেখা শেষে ১৮ শ শতকে তৈরি রোড জংশন পিকাডেলি সার্কাস দেখে হোটেলে ফিরলাম আমরা। এরপর বিকেলে কোনোমতে কিছু খেয়ে, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের প্রেস কনফারেন্স শেষ করে গেলাম টেমস নদীর পাড়ে বিখ্যাত লন্ডন ব্রিজ দেখতে। বিলেতের ছবি বলতে বোধ হয় এই ব্রিজের ছবিটাই আমরা সবচেয়ে বেশি দেখে থাকি। ব্যান্ডের সবাই তখনো ফুরফুরে। আগের দিনই যে এত লম্বা একটা জার্নি করে এসেছি তা বোঝার উপায় নেই। কারও তেমন ক্লান্তি নেই। লন্ডনের হলুদ নরম আলোয় ব্রিজটাকে দূর থেকে সোনার বার মনে হচ্ছিল। ফটো তুলতে তুলতে আবার দেখলাম তোড়জোড়। এগোতেই দেখলাম ব্রিজটা দুভাগ হয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। ব্রিজ ওপরে উঠল, তার মাঝখান থেকে নদীর বুক বেয়ে চলে গেল বিশাল এক জাহাজ। আমরা ভাগ্যবান—এসেই নাকি সবাই এই নামা-ওঠা দেখতে পায় না। অপেক্ষা করতে হয়।

 

পরদিন সকালে উঠেই চলে গেলাম ১৯৩১ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত রেকর্ডিং স্টুডিও অ্যাবের রোড স্টুডিওতে। সেখানে গিয়ে তো আমাদের পাভেল, ইমনরা পারলে কেঁদে ফেলে। বিটলস, পিংক ফ্লয়েডসহ পৃথিবীর বহু বহু বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের গানের আস্তানা ছিল এই অ্যাবে রোড স্টুডিও। বিশ্বের কত যে জনপ্রিয় গান এই স্টুডিও থেকে বের হয়েছে তার হিসাব নেই। একটা ব্যান্ড হিসেবে সেখানে নিজেদের পদচিহ্ন আঁকা নিশ্চয় অনেক বড় ভাগ্য এবং অনুপ্রেরণার বিষয়। সেখান থেকে দারুণ মুডে ফিরলেও সেদিন বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে আর্জেন্টিনার হারে সব খুশি মাটি হয়েছিল আমার আর ইমনের। যদিও দিদার, নীরব, পাভেল সেটাতেই আনন্দিত ছিল, কারণ তারা ব্রাজিলের সাপোর্টার। আমাদের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার সাগর ভাইকে অবশ্য খেলা নিয়ে কোনো উত্তেজনায় ভুগতে দেখিনি।

পরের দিন ১ জুলাই সকালে সাউন্ড চেকের পর বিকেলে প্রায় চল্লিশ হাজারের বেশি শ্রোতার সামনে বৈশাখী মেলার খুব সুন্দর কনসার্টটি করি আমরা। বাংলাদেশের সংস্কৃতির নানা রং-বর্ণ নিয়ে কনসার্টের পুরো আয়োজনটি ছিল চমৎকার। আয়োজকেরাও ছিলেন খুবই আন্তরিক। মেলায় আসা সবাই আমাদের সঙ্গে গলা ছেড়ে গেয়েছেন ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’, ‘আহারে জীবন’, ‘দুনিয়া’, ‘যাদুর শহর’, ‘কানামাছি’, ‘খাজনা’সহ সব গান। নিজেদের তৈরি বাংলা গানে দেশের বাইরে এত সাড়া পেয়ে ভীষণ ভালো কেটেছে দিনটি আমাদের। আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন দেশের অনেক প্রিয় মানুষ, প্রবাসী কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা। খুব ভালো লেগেছে এত দিন পর সবার সঙ্গে দেখা হয়ে। কনসার্ট শেষে রাতে আমরা বিবিসি এশিয়ান নেটওয়ার্কের জনপ্রিয় উপস্থাপিকা নাদিয়া আলীর শোতে অংশ নিই। এরপরে শুরু হয় চিরকুটের মেগা ভ্রমণ পর্ব। পরের দিন সকাল সকাল দেখে ফেললাম বিগবেন, লন্ডন আই। বিগবেনটা অবশ্য ঠিকমতো দেখা যায়নি কারণ এর সংস্কারের কাজ চলছিল। এরপর বাকি দিনটা মিউজিকের দোকানে ঘোরাঘুরি শেষে রাতের ট্রেনে আমরা চলে যাই ম্যানচেস্টারে। উদ্দেশ্য, পিংক ফ্লয়েডের জীবন্ত কিংবদন্তি রজার ওয়াটার্সের কনসার্ট দেখা। কনসার্ট দেখার আগে সারা দিন আমরা ক্লাব ফুটবলের অন্যতম শক্তিধর ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-এর স্টেডিয়াম, ম্যানচেস্টার টাউন হল, শহরের প্রাচীন সব ক্যাথেড্রাল, মিডিয়া সিটি ঘুরে বেড়িয়েছি সারা দিন। সন্ধ্যায় রজার ওয়াটার্সের কনসার্ট দেখে একসঙ্গে কেঁদেছি সবাই, কী দুর্দান্ত শক্তিশালী উপস্থাপনা, কী দারুণ প্রডাকশন।

 

পরদিন বাসে চেপে খুব ভোরে চলে যাই স্কটল্যান্ডের বিস্ময়কর এডিনবার্গ (স্কটিশরা বলে এডিনবরা) শহরে। শহরটা পুরোটাই রূপকথার মতো। হাজার বছরের ঐতিহ্য, স্থাপত্য কী যত্নে ধরে রেখেছে এই শহর। সারা দিন ঘুরে দেখে ফেললাম এডিনবার্গ ক্যাসেল। এক ক্যাসেল ঘুরতেই দিন লেগে যায় প্রায়। এরপর কিছুটা সময় হাতে থাকায় চট করে চলে যাই পোর্তোবেলা বিচে। রাত তখন ৮টা। তবু সূর্যের নরম আলোয় ঠান্ডা বাতাসে ক্লান্তিকে ছুটি দিলাম তখন। কারণ, পরের দিন আবার ছুটতে হবে নতুন এক শহরে। ছুটলাম। নতুন এ শহরের নাম অ্যাবারডিন, ট্রেনে যেতে সময় লাগবে ৩ ঘণ্টা। অ্যাবারডিনে নাফিজ তাঁর নিজের রেস্টুরেন্টে জোর করেই খাওয়াল। হাতে সময় মাত্র ৬ ঘণ্টা, পাড়ি দিতে হবে শত শত মাইল। পরবর্তী গন্তব্য হাইল্যান্ড আর স্টোনহেভেন। সুপারম্যানের মতো নাফিজ গাড়ি টানা শুরু করল। আমরা দেখলাম হাইল্যান্ডস, যেখানে শীতে পাহাড়গুলো সাদা হয়ে থাকে আর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসে স্কিইং করতে। এখন পাহাড়গুলো সবুজ, নতুন জীবনের মতো। সেটা দেখা শেষে হাইল্যান্ড লেক দেখলাম, গাড়ি জোরে ছুটল স্টোনহেভেনের দিকে। হাতে যা সময় আছে তাতে ট্রেন মিস হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু ট্রেন মিস করা যাবে না। রাতেই ফিরতে হবে এডিনবার্গে; কারণ সকালেই লন্ডন ফেরার ট্রেন। কথায় আছে ইচ্ছা যেখানে প্রবল, সৃষ্টিকর্তা সেখানে সহায় হন। আমরা পৌঁছে গেলাম স্টোনহেভেনে; ৬০০ বছরের পুরোনো ‘দুন্নত্তার’ ক্যাসেলে। আটলান্টিকের তীর ঘেঁষে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ক্যাসেল। চারপাশ সুনসান। ল্যাভেন্ডারের হাওয়ায় কি এক স্বর্গীয় অনুভূতি। মনে হচ্ছিল সারা জীবন যদি এখানে কাটাতে পারতাম। কিন্তু সেই অনুভূতির ইতি টেনে দেরি না করে ছুটতে হলো ট্রেন স্টেশনে। আর ১ মিনিট পরে পৌঁছালেও ট্রেনটা মিস করতাম। অদ্ভুত আচ্ছন্ন মোহে রাতের বুক চিরে ট্রেন ছুটল এডিনবার্গের দিকে। আমাদের আলোচনায় তখনো দুন্নত্তার ক্যাসেল, রাজা, রানি, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, যুদ্ধ, ইতিহাস। সেই আমেজেই ফিরলাম এডিনবার্গ। সেখান থেকে লন্ডন। অবশেষে এখানেই শেষ হলো চিরকুট-এর আরেকটি শ্বাসরুদ্ধকর, অবিস্মরণীয় ভ্রমণকাহিনি।

আমরা ব্যান্ডের সবাই ঘুরতে অনেক বেশি পছন্দ করি। গত ৭-৮ বছর দেশে-বিদেশে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরেছি। যত ঘুরি তত মনে হয় বিশাল এই পৃথিবীতে কত ক্ষুদ্র, কত তুচ্ছ আমরা। আমরা যা করছি তা এই বিশালতার কাছে কিছুই না। এই অনুভূতি আমাদের বিনয়ী হতে শেখায়, আরও বেশি মাটির কাছাকাছি হতে শেখায়।

 

Share