নিউজ ডেস্ক : বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক বাদল মিয়া প্রধানত আলুচাষি। আলুর জমিতে বছরে একবার সামান্য ধান চাষ করলেও তাতে তার পরিবারের চাহিদার সমান চাল পান না। ফলে আলু বিক্রির টাকায় বছরের বেশিরভাগ সময় চাল কিনে খেতে হয়। কিন্তু এবার আলুর দাম কম পাওয়ায় বড় বিপাকে পড়েছেন বাদল মিয়া। কারণ বাজারে ১০ কেজি আলু বিক্রি করে ১ কেজি চাল মিলছে।
এবার ফলন ভালো হয়েছে, তবে স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি আলু ৩ থেকে ৫ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। আর এই দামে ১০ থেকে ১২ কেজি আলু বিক্রি করে ১ কেজি চাল ৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। চালের দাম বাড়লেও আলুর দাম কমেই চলেছে। একই সময়ে ঋণের টাকা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ কারণে লোকসান দিয়ে সস্তায় আলু বিক্রি করছেন কৃষকরা।
এবার বছরজুড়ে দেশের বাজারে সবচেয়ে কম দামের সবজি হলো আলু। এই আলুর দাম সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে আরও ৪ টাকা কমেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এখন প্রতি কেজি আলু জাতভেদে সর্বনিম্ন ৩ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। যদিও এ আলু উৎপাদনে কেজিপ্রতি ব্যয় হয়েছে গড়ে প্রায় সাড়ে ৭ টাকা। এর ফলে আলুচাষিরা বড় লোকসানে পড়েছেন।
এদিকে বাজারে এখন চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে চাল। প্রতি কেজি মোটা ও মাঝারি মানের চাল কিনতে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা গুনতে হয়। মোটা গুটি ও স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৭ টাকা এবং পাইজাম ও লতা চাল ৫০ থেকে ৫৭ টাকা। এই দামে এক কেজি চাল কিনতে ১০ থেকে ১২ কেজি আলু বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশর তথ্য অনুযায়ী, চালের এই দাম গত বছরের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি।
বাদল মিয়া জানান, এক বিঘা জমি চাষে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার খরচ হয়েছে। এতে বিঘাপ্রতি আলু উৎপাদন হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ মণ। প্রতি মণ আলু বিক্রি করছেন ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। এতে বিঘায় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। বাদল মিয়ার মতো দেশের অন্য এলাকার আলুচাষিরাও একই সমস্যায় পড়েছেন।
বগুড়া সদর উপজেলার বড় ধাওয়া গ্রামের কৃষক মনির হোসেন জানান, প্রতি কেজি গ্রানুলা ৩ থেকে সাড়ে ৩ টাকা এবং কার্ডিলাল, পাকড়ি ও ডায়মন্ড জাতের আলু ৫ থেকে ৬ টাকায় বিক্রি করছেন। গত বছরও লোকসান দিয়ে আলু বিক্রি করেছেন। এবারও লোকসান হচ্ছে। এভাবে দাম কমলে অনেক কৃষক আলু চাষ বন্ধ করে অন্য ফসল চাষ করবেন। বগুড়ার চেয়ে কিছুটা বেশি দামে মুন্সীগঞ্জে জাতভেদে প্রতি কেজি আলু ৫ থেকে ৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ওই এলাকার কৃষকরা জানান, এখন যে দামে বিক্রি হচ্ছে তাতে উৎপাদন খরচ উঠছে না।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পাইকারি আড়তে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে গ্রানুলা আলু ৮ টাকা কেজি ও ডায়মন্ড আলু ৯ থেকে ১০ টাকা কেজি। এই বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন সমকালকে বলেন, সপ্তাহের ব্যবধানে আলুর দাম কেজিতে ৪ টাকা কমেছে। বর্তমান ডায়মন্ড আলু সাড়ে ৯ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। আর এখন বেশিরভাগ সবজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। এভাবে দাম কমতে থাকলে আলু চাষে কৃষকরা নিরুৎসাহিত হবেন।
খুচরা বাজারে প্রতি কেজি গ্রানুলা আলু ১২ টাকা ও ডায়মন্ড আলু ১৪ থেকে ১৬ টাকায় নেমেছে। যদিও কৃষক পর্যায়ে নেমেছে গড়ে ৫ টাকার কম। এ হিসাবে তিনগুণ বেশি দামে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কৃষকরা লোকসান দিলেও পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা ঠিকই লাভ করছেন।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশজুড়ে ৫ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর জামিতে আলু চাষ হয়। এতে প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। এবারও প্রায় একই হারে উৎপাদন হবে। জানা যায়, গত বছর আলু উৎপাদনে ৭ টাকা ৪০ পয়সা ব্যয় হয়েছে। এবার আলু উৎপাদনে প্রায় সাড়ে ৭ টাকা ব্যয় হয়েছে। বর্তমানে কৃষকরা এর চেয়ে কম দামে বিক্রি করছেন। কৃষি বিপণনের হিসাব অনুযায়ী, কৃষক পর্যায়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ লাভে প্রতি কেজি আলু সাড়ে ৮ থেকে ৯ টাকা যৌক্তিক মূল্য হওয়া উচিত। পাইকারিতে যৌক্তিক মূল্য ১৩ থেকে ২০ শতাংশ লাভে প্রতি কেজি ১০ থেকে ১১ টাকা। খুচরায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ লাভে যৌক্তিক মূল্য হওয়া উচিত কেজিপ্রতি ১২ থেকে ১৪ টাকা। এ হিসাবে খুচরা পর্যায়ে মুনাফা করলেও কৃষকরা লোকসান দিচ্ছেন।
এদিকে দেশে বছরে ৮০ লাখ টন আলুর চাহিদা রয়েছে। বাকি আলু রফতানি ও প্রক্রিজাতকরণের বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে গত মৌসুম শেষে আলু ফেলে দিয়েছেন কৃষকরা। এবারও একই অবস্থায় পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্নিষ্টরা। সারাদেশের মোট ৪১৬টি হিমাগারের গত বছর ৫২ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা হয়। এবার হিমাগারে আলু তুলতে শুরু করেছেন কৃষকরা। অন্য বছরের মৌসুমে আলু সংরক্ষণের সময় দাম বাড়ে। কিন্তু এবার উল্টো কমছে।
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কামরুল হোসেন চৌধুরী গোর্কী সমকালকে বলেন, আলুর বস্তা ব্যবহারে জটিলতার কারণে পুরোদমে হিমাগারে সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে আলুর দাম কমছে। এ বিষয়টি সমাধানের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন জানানো হবে। সমাধান পেলে পুরোদমে আলু সংরক্ষণ শুরু হবে। তখন মাঠ পর্যায়ে বেচাকেনা বাড়লে দামও বাড়বে। এ ছাড়া আলু রফতানি বাড়াতে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এতে কৃষকরা আলুর ভালো দাম পাবেন।