Current Date:Sep 22, 2024

সবচেয়ে বেশি কক্সবাজার নরসিংদী সিরাজগঞ্জ থেকে

অনলাইন ডেস্ক : কয়েক বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর চরম অর্থ সংকটে পড়েন কক্সবাজারের রামু উপজেলার হাবিবুর রহমান। সামান্য জমি চাষাবাদ করে আট সদস্যের সংসার আর চলছিল না। অভাব ঘোচানোর তাড়নায় দালালের প্রলোভনে সমুদ্রপথে পাড়ি জমান মালয়েশিয়া। সর্বস্ব বিক্রি করে নৌকায় চেপে বসলেও ফিরতে হয়েছে খালি হাতেই। সাগরপথে বহু নির্যাতন সয়ে শুধু ফেরাটাই হয়েছে হাবিবুরের। খুইয়ে এসেছেন কর্মক্ষমতার সবটুকুই।

হাবিবুরের মতো দেশের প্রায় সব জেলার মানুষই কম-বেশি পাচারের সম্মুখীন হচ্ছেন। দালালের খপ্পরে পড়ে সমুদ্রপথে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সমীক্ষা বলছে, এর মধ্যেও মানব পাচারের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে কক্সবাজার থেকে। দালালের প্ররোচনায় নরসিংদী ও সিরাজগঞ্জ থেকেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সমুদ্রপথে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

বৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ কমে আসাকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার সংকুচিত হতে থাকে ২০০৯ সাল থেকে। ২০১২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজারও এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। নানা চেষ্টায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললেও বৈধভাবে খুব বেশি মানুষ পাঠানো যায়নি। বৈধ পথে বিদেশ গমনের সুযোগ কমে আসায় অবৈধ পথে সমুদ্রযাত্রাকেই বেছে নিচ্ছে অনেকে। দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে ঝুঁকি নিয়েই তারা সাগর পাড়ি দিচ্ছেন।

২০১৬ সালের জুনে বিপত্সংকুল সমুদ্রপথে আন্দামান সাগর পাড়ি দেয়া যেসব বাংলাদেশী ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইওএম। সাক্ষাৎকার নেয়া ২ হাজার ৮১৩ জনের মধ্যে ১৮৩ জনের বয়স ১৭ বছরের নিচে।

ফিরে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে আইওএম বলছে, দেশের ৫৭টি জেলা থেকেই কম-বেশি মানুষ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড বা ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে সমুদ্রপথে পাড়ি দেন। এদের মধ্যে সংখ্যায় বেশি কক্সবাজারের মানুষ। সাক্ষাৎকার নেয়া ৫৫৪ জনই ছিলেন এ জেলার। অর্থাৎ মালয়েশিয়া গমনের উদ্দেশ্যে বিপত্সংকুল সমুদ্রপথ পাড়ি দেয়া নাগরিকদের প্রায় ২১ শতাংশ কক্সবাজারের।

কক্সবাজারের পরই সমুদ্রপথে বেশি পাড়ি জমান নরসিংদীর লোকজন। ২০১৬ সালে আন্দামান সাগর থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশীদের মধ্যে ১৪ শতাংশ ছিলেন এ জেলার। ওই সময় নরসিংদীর মোট ৩৬৭ জন মানুষ সে যাত্রায় বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন। সমুদ্র উপকূলের মানুষ না হওয়ার পরও কেন তারা এ পথ বেছে নেন?— এমন প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই তাদের কাছেও। কেউ কেউ বলেন, অন্যরা যাচ্ছে, তাই আমিও যেতে চেয়েছিলাম। কেউ আবার শুধু বলেন, ‘দালালের খপ্পরে পড়েছিলাম।’

নরসিংদীর মতোই দালালদের খপ্পরে পড়ছেন সিরাজগঞ্জের বাসিন্দারাও। আন্দামান থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশীদের মধ্যে এ জেলাটির বাসিন্দা ছিলেন ১৮৭ জন। এর মধ্যে বেলকুচি উপজেলার ১৩ জন। এদেরই একজন উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের রানা প্রামাণিক। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ না হওয়ায় বাবার সঙ্গে কৃষিকাজকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। একসময় বিদেশে মোটা অংকের চাকরির প্রলোভনে দালালের খপ্পরে পড়েন রানা প্রামাণিকও। অবৈধভাবে সমুদ্রপথে পাড়ি জমান মালয়েশিয়ার উদ্দেশে। এক বছর পর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসেন বাড়িতে।

সেই ঘটনার বর্ণনা করে গতকাল বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ভালো চাকরি দেয়ার নাম করে আমাকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার কাছে থাকা ৫ হাজার টাকাও এ সময় নিয়ে নেয়া হয়। এরপর সাড়ে তিনশ যাত্রীর সঙ্গে একটি ট্রলারে তোলা হয় তাকেও। মাঝসমুদ্রে ৪০ দিন অবস্থান করে ট্রলারটি। কেউ পাশ ফিরলেই আঘাত করা হতো। দালালচক্রের কাছে থাকা ছুরি, বন্দুক দিয়ে হত্যার হুমকিও দেখানো হতো।

অন্যান্য জেলার মধ্যে ঝিনাইদহ, সুনামগঞ্জ, যশোর, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের লোকজনের মধ্যেও সমুদ্রপথে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেশি। ২০১৬ সালে দেশে ফেরা আড়াই হাজার জনের মধ্যে এসব জেলার বাসিন্দা ছিলেন যথাক্রমে ১৩৪ জন, ১২৮, ১২৪, ১২০, ১১৮, ১০৫, ৯৬, ৮০, ৭৮ ও ৭২ জন। এছাড়া বেঁচে ফেরাদের মধ্যে ৬২ জন ছিলেন কিশোরগঞ্জের, পাবনার ৫৩, বান্দরবানের ৪৪, টাঙ্গাইলের ৩৭, সিলেটের ৩৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২৫, কুমিল্লার ২২, কুষ্টিয়ার ২০, সাতক্ষীরার ২০ ও জয়পুরহাটের ১৯ জন। পাশাপাশি শরীয়তপুরের বাসিন্দা ছিলেন ১৯, মেহেরপুরের ১৭, মাগুরার ১৩ ও ময়মনসিংহের ১২ জন।

বৈধ পথে প্রচলিত বাজারগুলোয় জনশক্তি রফতানি কমে যাওয়ায় ও নতুন বাজারগুলোয় সুবিধা করতে না পারা এর অন্যতম কারণ বলে জানান বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে যখন সমুদ্রপথে মানব পাচার হয়েছিল, সে সময় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার মতো প্রধান শ্রমবাজারগুলো প্রায় বন্ধ ছিল। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশেও শ্রমিক পাঠানো বন্ধ ছিল। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে অবৈধ পথ বেছে নিয়েছিলেন।

বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়া লোকজনও ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে বিদেশ পাড়ি দিতে চাইছেন বলে জানান তিনি। তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, দালালরা তাদের বিনা খরচে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া নেয়ার প্রলোভন দেখায়। সংকটে থাকায় দালালদের এ প্রস্তাব সহজেই লুফে নেয় তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমুদ্রপথে মানব পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক ৩২ জেলায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী, সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা— এসব জেলা থেকে বেশির ভাগ মানব পাচার হয়েছে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের লোকজনকে জোর করে পাঠানোর ঘটনা থাকলেও মূলত অন্যান্য জেলার লোকজনকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়। কক্সবাজার থেকে যারা পাচার হয়েছেন, তাদের অনেকে আবার রোহিঙ্গা। তারা আগে থেকেই পাচারকারী দালালদের সঙ্গে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত।

সমুদ্রপথে মানব পাচারসহ চোরাচালান রোধে নিয়মিত টহল দেয় বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বাহিনী। জানতে চাইলে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বাহিনীর মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এএমএমএম আওরঙ্গজেব বলেন, মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে এ বছর মানব পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু কোস্টগার্ড বাহিনীর ব্যাপক নজরদারির কারণে তা হয়নি। সমুদ্রপথে কোস্টগার্ড বাহিনীর ব্যাপক নজরদারি থাকায় পাচারকারীরা লোকজনকে নৌ বা সমুদ্রপথে পাঠাতে পারেনি।

Share