Current Date:Oct 3, 2024

হাসপাতালের অব্যবস্থাপনাও বিদেশমুখী করছে রোগীদের

অনলাইন ডেস্ক : রোগীর সর্বোত্তম সেবা ও নিরাপত্তা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার প্রধান কাজ। রোগী সন্তুষ্টির অনেকখানিই নির্ভর করে হাসপাতালের সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর। যদিও বাংলাদেশের অনেক হাসপাতালে রোগীদের সেবার চেয়ে ভোগান্তিই পোহাতে হয় বেশি। প্রয়োজন না থাকলেও দীর্ঘ সময় রাখা হয় আইসিইউতে। অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগের নিয়মেও। এর ওপর লাইসেন্সবিহীন নামসর্বস্ব হাসপাতালে অপচিকিৎসা তো রয়েছেই। এসব অব্যবস্থাপনাও রোগীদের বিদেশমুখী হতে বাধ্য করে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ থেকে রোগীরা চিকিৎসার জন্য কেন বিদেশে যাচ্ছেন, তা নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছেন ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহমুদ আলী ও অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অনীতা মাধেকার। ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফেরা ১ হাজার ২৮২ জন রোগীর ওপর জরিপ চালান তারা। জরিপে হাসপাতালের অব্যবস্থাপনাকে বিদেশে যাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন চতুর্থ সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী।

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে রোগীদের বিদেশমুখিতার প্রধান তিনটি কারণের একটি বলে মত দেন হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. রুবায়ুল মোরশেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশের বেশির ভাগ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ওই চিকিৎসকের সেবা থেকে বঞ্চিত হন রোগীরা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে যোগ্যতা না থাকলেও এ দায়িত্ব পান অনেকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও আমাদের এখানে পায় না।

দেশের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট হতে না পেরে চিকিৎসা নিতে ভারতে পাড়ি দেন সরকারি কর্মকর্তা নাজির আহমেদ। ২০১৪ সালের নভেম্বরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাম পায়ে সার্জারির পর বায়োপসি রিপোর্টে ক্যান্সার ধরা পড়ে তার। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে অব্যবস্থাপনার কথাই বেশি জানতে পারেন তিনি। পরে দেশের কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের আস্থা পাননি নাজির আহমেদ। সিদ্ধান্ত নেন ভারতে যাওয়ার। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।

বণিক বার্তাকে নাজির আহমেদ বলেন, ওখানে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। থাকা-খাওয়ার কষ্ট একটু আছে। তবে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি নেই।

নাজির আহমেদের মতোই দেশে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতি বছর ১ লাখ ২২ হাজার মানুষ। তাদেরও বড় অংশই ভারতে পাড়ি জমাচ্ছেন দেশের হাসপাতালে অব্যবস্থাপনার কারণে আস্থাহীনতা থেকে।

বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের অনকোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক (লে. কর্নেল অব.) ডা. মো. মোফাজ্জেল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে রেডিয়েশন মেশিনের অনেক ঘাটতি রয়েছে, আরো অনেক রেডিয়েশন মেশিন দরকার। এছাড়া ভালো কিছু সেন্টার প্রয়োজন, যেখানে এক ছাদের নিচে অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি পাওয়া যাবে। এ তিনটির সমন্বিত ব্যবস্থাপনা থাকলে হাসপাতালের প্রতি রোগীর আগ্রহ বাড়বে।

হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা দুর্বলতায় অপচিকিৎসার ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই। গত ১৩ মে এর শিকার হয় নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দ এলাকার নূরে আলমের ১১ বছরের মেয়ে নুসরাত আক্তার নীরা। টনসিলের ব্যথা নিয়ে নারায়ণগঞ্জের মুক্তি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে তাকে অস্ত্রোপচার করা হয়। দুই ঘণ্টা অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকরা নীরাকে মৃত ঘোষণা করেন। স্বজনদের অভিযোগ, ভুল চিকিৎসার কারণেই মৃত্যু হয় নীরার।

গত বছরের অক্টোবরে রাজশাহীর একটি হাসপাতালে তামান্না পারভীন (২৮) নামের এক রোগীর অস্ত্রোপচারের সময় নবজাতকের মাথা কেটে ফেলা হয়। এতে ওই নবজাতকের মৃত্যু হয়। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি ওই শিশুর স্বজনদের।

এসব অব্যবস্থাপনাকে রোগীদের বিদেশমুখী করার অন্যতম কারণ বলে মানছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, হাসপাতালের অপর্যাপ্ত সেবা ও ভুল ডায়াগনস্টিকের কারণে রোগীরা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এর ফলে অনেকেই চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। রোগীরা প্রায়ই ভুল ডায়াগনস্টিকের কারণে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। ভুল ডায়াগনস্টিক হলে ভুল চিকিৎসা হয়, এতে শারীরিক ও আর্থিকভাবে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর একবার কেউ ভুল

ব্যবস্থাপনার শিকার হলে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়। কেউ নিজে বা তার পরিচিত কেউ দেশে চিকিৎসা নিয়ে ভুক্তভোগী হলে, তারা পরে দেশের বাইরে যান।

তবে এর সঙ্গে খানিকটা দ্বিমত পোষণ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন। হাসপাতাল অব্যবস্থাপনার কারণে রোগীরা বিদেশে গেলেও সংখ্যাটা খুব বেশি নয় বলে দাবি করেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চিকিৎসা ব্যয় কিংবা হাসপাতাল অব্যবস্থাপনার কারণে বিদেশে গেলে এ হার ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ছয়জন হবে। বাকিরা যান বিভিন্ন কারণে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার পেছনে মানসিক কারণ বেশি জড়িত। এজন্য বিদেশী বিভিন্ন হাসপাতালের এজেন্ট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রচারণা অনেকটা দায়ী।

Share