ওজন বাড়লে ঘুম কমে

0
330

অনলাইন ডেস্ক : রাতে ভালো ঘুম না হওয়া। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া। ঘুম না আসা, ঘুমের ঘোরে নাক ডাকা, কখনো কখনো নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া। দিনে কাজের সময় ঝিমুনি ভাব—এসব সমস্যার কথা বন্ধু ও পরিচিতজনদের আড্ডায় এখন প্রায় নিয়মিতই শুনতে পাওয়া যায়। চিকিৎসকেরা বলছেন, উচ্চতার তুলনায় ওজন বেশি হলে নাক ডাকা ও ঘুম কম হওয়ার সমস্যা দেখা দেয়।

গত বুধবার বিকেলে ঘুমের সমস্যা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নাক, কান ও গলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কামরুল হাসান তরফদারের ব্যক্তিগত চেম্বারে যান গৃহবধূ আমেনা খাতুন। তাঁর বয়স ৫০ বছর। সমস্যা শুনে চিকিৎসক আমেনাকে বললেন, উচ্চতার
তুলনায় ওজন বেশি তাঁর। ব্যবস্থাপত্রে ওজন কমানোর পরামর্শ দিলেন।

এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ওজন বেশি বা মোটা ব্যক্তিদের ঘুম কম হয়। যাঁরা মানসিক চাপে থাকেন, তাঁদেরও ঘুম কম হয়। দেশে দুই ধরনের মানুষই বাড়ছে। তিনি বলেন, ঘুম কম হলে মানুষ মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারে না। ফলে মানুষের কার্যক্ষমতা কমে যায়।

বাংলাদেশের কত মানুষ ঘুমের সমস্যায় ভুগছে, সে-সংক্রান্ত কোনো গবেষণা বা পরিসংখ্যান নেই। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ৪ জুন প্রকাশিত ঘুমবিষয়ক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী স্লিপ-এর এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের প্রতি তিনজনের একজন ঘুমের সমস্যায় ভুগছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, যাদের ঘুম কম হয়, তাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বেশি। তারা সহজে বিরক্ত হয়, স্মরণশক্তি হারায়। ঘুম কম হওয়া মানুষের যোগাযোগ ও বিচারক্ষমতা দুর্বল হয়। তাদের সহমর্মিতাবোধও কম হয়ে যায়। এ ছাড়া ঘুম কম হলে হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়ে।

ঘুমের সমস্যা নিয়ে দেশের মানুষকে সচেতন করার কাজ করছে চিকিৎসকদের সংগঠন ‘সোসাইটি অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশ। সংগঠনের মহাসচিব অধ্যাপক মণিলাল আইচ প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে ও হাসপাতালে অন্য রোগের চিকিৎসা নিতে আসা বিপুলসংখ্যক মানুষ ঘুমের সমস্যার কথা বলেন। ঘুমের সমস্যায় আক্রান্ত মানুষ বাড়ছে। এটি জনস্বাস্থ্য সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে জাতীয়ভিত্তিক কোনো তথ্যভান্ডার এখনো করা হয়নি।

গবেষণার তথ্য
ঘুম নিয়ে বৈজ্ঞানিক সাময়িকী স্লিপ প্রকাশিত প্রবন্ধে বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার ৩৩ থেকে ৪৫ শতাংশ মানুষ ঘুমের সমস্যায় ভুগছে। যুক্তরাষ্ট্রে দিনে সাত ঘণ্টা ঘুমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু দেশটির ৩৫ শতাংশ মানুষ ওই পরিমাণ সময় ঘুমাতে পারে না। কানাডার ৩০ শতাংশ মানুষ মনে করে, তারা পর্যাপ্ত ঘুমাচ্ছে না। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে এই হার যথাক্রমে ৩৭ ও ২৬ শতাংশ। এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরে ২৮ শতাংশ মানুষের ঘুমের সমস্যা দেখা গেছে।

গবেষকেরা বলছেন, ঘুম কম হলে তার আর্থিক মূল্য ব্যক্তিকে এবং সমষ্টিগতভাবে দেশকে দিতে হয়। ঘুম কম হলে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ে, ব্যক্তির উৎপাদনশীলতা কমে যায়, কাজে অনুপস্থিতির হার বাড়ে, অপরিণত মৃত্যু বেড়ে যায় (যেমন সড়ক দুর্ঘটনা)।

পর্যাপ্ত ঘুম দরকার
চিকিৎসকেরা বলছেন, ঘুম মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বিশ্রাম দেয়। ঘুমের সময় শরীর বেশি পরিমাণে অক্সিজেন নিতে পারে। এই অক্সিজেন মানুষকে সতেজ করে। তবে কতটা ঘুম পর্যাপ্ত তার কোনো সীমা নেই। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্যবিদেরা দেশটির নাগরিকদের জন্য ঘুম বাবদ সাত ঘণ্টা সময় বরাদ্দ রাখার সুপারিশ করেছেন।

সোসাইটি অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক মণিলাল আইচ বলেন, ‘আমরা ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানোর কথা বলি।’ তিনি আরও বলেন, যে সময়টুকুই মানুষ ঘুমাক না কেন, তা হতে হবে একটানা গভীর ঘুম। ঘুমে কোনো ব্যাঘাত যেন না ঘটে।

ঘুম হচ্ছে না
ঘুম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রবন্ধে (দ্য ইকোনমিক কস্ট অব ইনএডুকোয়েট স্লিপ) বলা হয়েছে, জাঙ্ক ফুড (চর্বি, শর্করা ও লবণ বেশি থাকে) খেলে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসকেরা বলছেন, স্থূলকায় মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হয়। তাতে ঘুমের সময় মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যায়। হঠাৎ মানুষের ঘুম ভেঙে যায়। বারবার ঘুম ভাঙা মানুষ উচ্চরক্তচাপ ও হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, মানুষের জীবনাচারের (লাইফ স্টাইল) পরিবর্তনও গভীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। একটা সময় বলা হতো টেলিভিশন মানুষের ঘুমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ না ঘুমিয়ে বসে বসে টেলিভিশন দেখত। এখন এসেছে ইন্টারনেট ও ফেসবুক। মানুষ শুয়ে থাকে ঠিকই। কিন্তু না ঘুমিয়ে অন্য কাজে সময় কাটায়।

চিকিৎসকেরা বলছেন, ঘুম অভ্যাসের ব্যাপার। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে। মানসিক বা শারীরিক কোন কারণে ঘুম কম হচ্ছে, তা পরিমাপ করার প্রযুক্তি এখন দেশেই রয়েছে। কারও ঘুমের সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।