নিম্নমুখী সোয়েটারের অর্ডার মালিক-শ্রমিকদের দুঃসময়

0
164

ডেস্ক রিপোর্ট : গেল কয়েক বছরে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সোয়েটারশিল্পে সুদিন ফিরে আসে। বেড়ে যায় দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি। তৈরি হতে থাকে নতুন নতুন কারখানা। বলাচলে বিশ্বের প্রায় সব ব্র্যান্ডের পণ্য উৎপাদন শুরু করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য সোয়েটারের একটা বড় অংশ চলে যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। দেখা দেয় সোয়েটার তৈরি পোশাকশিল্পে রপ্তানির ব্যাপক উন্নতি। বিগত বছরগুলোতে রপ্তানির পরিমাণ দেখলে বোঝা যায়। এক বছর রপ্তানি কিছুটা কম হলে পরের বছর সেই ক্ষতি কাটিয়ে আরও বেশি রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু চলতি বছর সোয়েটার উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সাধারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীরা হাত তুলে বসে আছে। যা গেল বছর এই সময় ওইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা কাজ করে দম ফেলার সময় পর্যন্ত পায়নি। কিন্তু এবছর তার উল্টো চিত্র। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে বহির্বিশে^ ২০১২-১৩ অর্থ বছরে সোয়েটার রপ্তানি হয় ২,৬২০,৭৩০,৩৫২.৩৯ ইউএস ডলার, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে কিছুটা বেড়ে রপ্তানি হয় ২,৯৩২,৯৩৭,৯৫২.০৫ ইউএস ডলার, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে কমে রপ্তানি হয় ২,৮২৯,১৬২,১৫৫.৪৮ ইউএস ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে আবার বেড়ে রপ্তানি হয় ৩, ১৮২,৪৬৬,৫৮২.৩৬ ইউএস ডলার, ২০১৬-১৭ আরো বেড়ে রপ্তানি হয় ৩,৩৬১, ১৪৭,৫৩৬.৫৪ ইউএস ডলার। বিগত বছরগুলো পরিসংখ্যান করলে দেখা যায়, চলতি বছরে সোয়েটার উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের চাপ বেশি থাকার কথা। কিন্তু উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে জানা যায় সেখানে কাজের চাপ অনেক কম। সাধারণ প্রতিষ্ঠানগুলো দাবি করছেÑ গেল বছরের চেয়ে চলতি বছর কাছের অর্ডার কমেছে প্রায় ৩০%। গত বছর এসময় কারিগররা কাজ করে দম ফেলার সময় পায়নি। তখন একজন কারিগর রাত-দিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করতো। আর এখন তারা ১০/১২ ঘণ্টা কাজ করে বসে থাকে। সাধারণত সোয়েটারের উৎপাদন সময় এপ্রিল-সেপ্টেম্বরÑ এ ৬ মাসকে পূর্ণ সিজন হিসাবে ধরে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো। বাকি ৬ মাস অফ সিজন থাকে। তখন কাজের তেমন একটা চাপ থাকে না। একটা সময় ছিল শ্রমিকরা পূর্ণ সিজনে ৬ মাস কাজ করতো বাকি ৬ ছয় মাস শ্রমিকদের হাতে কোনো কাজ থাকতো না। যে কারণে অনেক শ্রমিক এ কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতো। কিন্তু বর্তমানে প্রায় প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বেতনে নিয়ে এসেছে। আর সোয়েটারশিল্পে বেশিরভাগ ২০-৩০ এই বয়সের শ্রমিক কাজ করে। ৩০-এর ঊর্ধ্বে কমসংখ্যক শ্রমিক রয়েছে। একটা সময় ৪ জন শ্রমিক যে কাজ করতো বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির কারণে ৪ জনের কাজ ১ জন শ্রমিক অনায়াসে করতে পারছে। যে কারণে বাধ্য হয়েই কারখারা মালিকদের শ্রমিক সংখ্যা কমাতে হচ্ছে। বাংলাদেশ নিটওয়ার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে তিনশর মতো সোয়েটার কারখানা রয়েছে। যেখানে প্রায় চার লাখ শ্রমিক কাজ করে। বর্তমানে প্রতিটি কারখানাতেই আধুনিক মেশিনের আওতাভুক্ত। সোয়েটারে প্রযুক্তির কারনে যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো দিকও রয়েছে। প্রযুক্তি আসার কারণে কারখানায় কমসংখ্যক শ্রমিক লাগছে। বর্তমানে একজন শ্রমিক ৪ জনের কাজ করতে পারে। আবার এই শিল্পের বেশিরভাগ শ্রমিক অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত তাই অনেকেই তাদের মধ্যে মেশিন চালাতে অক্ষম। ফলে বাধ্য হয়েই তাদের চাকরি ছাড়তে হচ্ছে। এটা তো পুরনো সমস্যা। বর্তমানে আবার এই খাতে নতুন করে সমস্যা যোগ হয়েছে। কারখানায় অর্ডার কম হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের দেনার ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। সোয়েটার খাতে মন্দা হবার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে এ বিষয়ে মোটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান মাসুদ কবির বলেন, গেল বছর থেকে সোয়েটারের অর্ডার নি¤œমুখী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো মূলত সিজনাল ফ্যাশনেবল প্রোডাক্ট বিশ্ব বাজারে প্রবণতা চালু হয় ৯০-এর শেষেরদিকে। নতুন প্রজন্মের কাছে সোয়েটার ফ্যাশন জনপ্রিয়তা না হওয়ার কারণে বিশ্ব বাজারে চাহিদা কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে পড়ছে। এছাড়া বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের চাহিদার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি চাইনিজ ব্র্যান্ডের এটো জ্যাকার্ড মেশিন আমদানি হয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কারখানায় উৎপাদন কম হওয়াতে তারা ব্যাংকের দেনায় জর্জরিত আছে। তিনি বলেন, সোয়েটারে অধিক ম্যান পাওয়ার বেইজ উৎপাদন হওয়ায় ইতোমধ্যেই চায়নারা ৫০%-৬০% উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এবং এর বিকল্প হিসাবে সুয়েট শার্ট, সুয়েট জ্যাকার্ড, ফ্লিস আইটেমের উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে। চায়নারা খুব দ্রুত সোয়েটারের বিকল্প বাজার তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের বড় দুর্বলতা হলো এখানে নতুন ডিজাইন, নতুন সূতা-ফেব্রিস আবিষ্কার এবং ফ্যাশন প্রবণতা নিয়ে কোনো ধরনের মনিটরিং বা কৌশল প্রণয়নের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কেউ নেই। যে কারণে বিশাল বিনিয়োগের এই খাত এখন ঝুঁকির মুখে। এক প্রশ্নের জবাবে নিট কনসার্ন গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার তানজির ওয়াহিদ বলেন, তুলনামূলকভাবে গত বছর থেকে চলতি বছর সোয়েটারে মন্দ সময় যাচ্ছে। তবে এর প্রভাবটা বেশি পড়েছে জেনারেল প্রতিষ্ঠানগুলোতে। যারা সব সময় সাব কন্ট্রাক্টে কাজ করে থাকে তাদের এ বছর আগের তুলনায় অর্ডার অনেক কম হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এমন অবস্থা চলতে থাকলে কারখানা ও শ্রমিকদের জন্য ভালো খবর বয়ে আনবে না। কারখানা বেঁচে থাকলে তবেই শ্রমিক বাঁচবে। তবে জেনারেল কারখানাগুলো ছাড়া ভালো মানের কারখানাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় উল্টো চিত্র। ওইসব প্রতিষ্ঠানে কাজের চাপ আগের মতই। সমষ্টিগতভাবে কাজের চাপ কেমনÑ এ প্রশ্নের জবাবে প্রীতি গ্রুপের সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, প্রতি বছরই কাজের চাপ থাকে অনেক বেশি, এবছরও রয়েছে। তবে বিগত বছরগুলো থেকে চলতি বছর অর্ডার অনেকটা কম। প্রতিবছর আমাদের প্রতিষ্ঠান যে হারে কাজের অর্ডার পেয়ে থাকে এবছর আশানুরুপ পায়নি। কারখানায় যে পরিমাণ সোয়েটার তৈরি হয় তার সমানসংখ্যক বিভিন্ন জেনারেল প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সাব-কন্টাক্টে করিয়ে নেয়া হয়। চলতি বছর সাব-কন্টাক্টে কাজের তেমন চাপ নেই। সেদিক থেকে সমষ্টিগতভাবে বলাই চলে সোয়েটারে মন্দা অবস্থা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিজিএমইএর-এর সহ-সভাপতি এস এম মান্নানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।