পানি বাড়ছেই, ভাঙন তীব্র

0
352

নিউজ ডেস্ক: বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের বিভিন্ন স্থানের নদ-নদীর পানি বাড়ছেই। কয়েকটি নদীর পানি কমলেও বিপত্সীমার নিচে নামেনি। বন্যায় এখনো হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। কিছু স্থানে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও নতুন বিপদ ভাঙনের মুখে পড়ছে নদী পারের মানুষ। ভাঙনের ভয়ে অনেকেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে এখনো ত্রাণ বিতরণ সেভাবে শুরু হয়নি। বন্যার কারণে শিক্ষা কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ধরলা নদীর পানি কমলেও এখনো বিপত্সীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি বাড়ছেই। এসব নদীর অববাহিকায় ৩০টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম চর গ্রাম ও দ্বীপচর প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে আছে ৬০ হাজার পরিবার। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রে ১২ ও দুধকুমারে তিন সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস জানিয়েছে, বন্যায় ৩৪৪টি পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। জেলায় ৪২৮টি স্কুলসহ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে এখনো ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়নি।

গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও উলিপুরে নতুন করে আরো ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানির নিচে চলে যাওয়ায় আমনের বীজতলা, ভুট্টা, কলাসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জলমগ্ন হয়ে পড়ায় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। ব্রহ্মপুত্র ও শাখা নদীরগুলোর অববাহিকায় চরাঞ্চলে নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার অনেক পাকা ও কাঁচা রাস্তায় পানি ওঠায় যোগাযোগব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। সদর উপজেলার হলোখানার সারোডোব এলাকায় কুড়িগ্রাম-ফুলবাড়ী সড়কটি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ঘরের ভেতর উঁচু মাচা করে অনেক বন্যার্ত আশ্রয় নিলেও অনেকেই উঁচু স্থান ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।

গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গো-ঘাট, সাঘাটার ভরতখালি ইউনিয়নের গোবিন্দি, হলদিয়া ইউনিয়নের গোবিন্দপুর, ফুলছড়ির গণকবর এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের লালচামার এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। তিন দিনে ওই সব এলাকায় আড়াই শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙনের মুখে আরো বেশ কিছু পরিবার তাদের ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। যারা এখনো ভাঙনকবলিত এলাকায় রয়েছে তারা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সদরের কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট গ্রামে নদীতীর সংরক্ষণের কিছু কাজ করা হলেও আরো বেশ কিছু এলাকা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। গোঘাটের ওই অরক্ষিত এলাকাতেই এখন ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনে অর্ধশতাধিক ঘর-বাড়িসহ গাছের বাগান ও আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তিন দিনের ভাঙনে অর্ধশতাধিক পরিবারের লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ভিটেমাটি হারা এসব পরিবারের চোখের পানি থামছে না। নিঃস্ব রিক্ত কয়েক শ মানুষ সব হারিয়ে ছুটছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দিকে। তাদের ক্ষোভের তীর ছুটছে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দিকে। কামারজানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম জাকির জানান, গত তিন দিনে তাঁর ইউনিয়নের গোঘাট, পূর্ব বাটিকামারী, পারদিয়ারা, খারজানি, রায়দাসবাড়ি ও নুনগোলা এলাকায় শতাধিক ঘর-বাড়িসহ অসংখ্য গাছপালা ও আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের তীব্রতা বাড়লেও পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন রোধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এলাকাবাসীর মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড গাইবান্ধা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহাবুবুর রহমান জানান, কামারজানির গোঘাট এলাকায় নদী ভাঙন রোধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ৪৮০ মিটার অংশে তীর সংরক্ষণ কাজের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এ জন্য তিন কোটি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদন না হওয়ায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।

জামালপুর : তিস্তা নদীর পানি এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনার পানি আরো বেড়েছে। গতকাল শনিবার সকাল থেকে যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপত্সীমা ১৯ দশমিক ৫০ মিটার ছুঁয়েছে। ফলে জামালপুরের ইসলামপুরের বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়নের চার গ্রামের ১৮ হাজার মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে। জানা গেছে, যমুনা নদীর পানি বাড়তে থাকায় ইসলামপুরের চিনাডুলি ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চিনাডুলি ইউনিয়নের দেওয়ানপাড়া এলাকায় বাঁধ উপচে জনবসতি এলাকায় পানি ঢুকছে এবং স্থানীয় পুইয়াকাটা খাল দিয়ে প্রবল বেগে যমুনার পানি ছড়িয়ে পড়ছে। শনিবার ওই এলাকায় পানি আরো বেড়েছে। ফলে যমুনাতীর ঘেঁষা দেওয়ানপাড়া, পাহলোয়ানবাড়ি, সিংভাঙ্গা ও ডেবরাইপ্যাঁচ গ্রামের লোকজন বন্যা ও ভাঙনের কবলে পড়ে তাদের ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় নলকূপগুলো ডুবে যাওয়ায় পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে। কিন্তু উপজেলা প্রশাসন বন্যা ও ভাঙনকবলিত গ্রামের দুর্গত মানুষের পাশে না দাঁড়ানোয় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বন্যা ও ভাঙনকবলিত দুর্গত পরিবারের লোকজন সরকারি সহায়তার দাবি জানিয়েছে।

চিনাডুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান জামালী জানান, তাঁদের বিদ্যালয়সহ স্থানীয় রামভদ্রা ও ডেবরাইপ্যাঁচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এস এন উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত করে শনিবার থেকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নায়েব আলী চিনাডুলি ইউনিয়নের বন্যা ও ভাঙন পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলেন, ‘ওখানে বন্যা ও ভাঙন দেখা দিয়েছে উপজেলা থেকে তা আমাকে জানানো হয়নি। আমি আজই (শনিবার) খোঁজ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

রংপুর : রংপুরের তিস্তাপারে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও চরগ্রামের পরিবারগুলোর দুর্ভোগ পিছু ছাড়েনি। তিস্তার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন শুরু হওয়ায় আতঙ্কে লোকজন ঘড়বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে তিস্তাপারে বন্যা দেখা দেয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার উজান থেকে আসা ঢলে তিস্তার পানি বাড়তে থাকে। ওই দিন রাতে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপত্সীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে ভাটি অঞ্চল গঙ্গাচড়ার ২৭টি চরগ্রামের প্রায় সাত হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। গতকাল শনিবার সরেজমিনে বন্যাকবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তিস্তা বাঁধসহ উঁচু স্থানে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলো এখনো তাদের বাড়িতে ফিরতে পারেনি। গতকাল সকাল থেকে পানি কমতে শুরু করলেও চরের বাড়িগুলোর আঙ্গিনায় কাদাপানি। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার এখনো উন্নতি হয়নি। পাশের বাড়িসহ হাট-বাজারে যেতে চরের মানুষের কলার ভেলাই একমাত্র ভরসা। লক্ষ্মিটারী ইউনিয়নের শংকরদহ এলাকার মনছুর আলীর ঘরে হাঁটু পানি। তিনি বলেন, ‘চুলা ধরাবার (জ্বালানোর) উপায় নাই। না খ্যায়া আর কতক্ষণ থাকা যায়।’ পূর্ব ইচলী গ্রামের জোবেদা বেগম সন্তানদের নিয়ে দুই দিন ধরে নিরাপদ স্থানে আছেন। তিনি বলেন, ‘পানি তো কমছে, তয় বাড়িত যামু ক্যামনে! বান (বন্যা) আইসা ঘড়ের খুঁটি-বেড়া নড়বড়া কইরছে। এ্যালা ভালো করতি ট্যাকা পাঁও কোনটে!’ গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ এনামুল কবির বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেতুর ভাঙনরোধে আপাতত বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে।