কেবল কামরুল নয়, আরো অনেকের সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল দীপার!

0
111

রংপুর প্রতিনিধি : মানুষের শ্রদ্ধা জানানো শেষে বুধবার রাতে রংপুর মহানগরীর দখিগঞ্জ শ্মশানে দাহ করা হয়েছে স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার দীপা ভৌমিকের পরকীয়ার জেরে খুন হওয়া অ্যাডভোকোট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনার লাশ। তদন্ত সংস্থাগুলোর সূত্র মতে, শুধু কামরুলের সাথেই নয়, একাধিক ব্যক্তির সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন দীপা। ২৪ বছর আগে একই দিনে একই স্কুলে নিয়োগ পাওয়া কামরুল ও দীপার দীর্ঘ অবৈধ সম্পর্কের একটি সমাধান চেয়েছিলেন রথীশ। এ দিকে এ হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতারকৃত দীপা ও তার প্রেমিক কামরুল, রথীশের সহকারী মিলন মোহন্তসহ ৯ জনকে গতকাল আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

লাশে মানুষের শ্রদ্ধা : বুধবার রাতে নগরীর দখিগঞ্জ শ্মশানে যখন অ্যাডভোকেট বাবু সোনার লাশ দাহ করা হয়, তখন সেখানে শত শত মানুষ অংশ নেন। এর আগে তার লাশ আইনজীবী সমিতি, আদালত প্রাঙ্গণ, পাবলিক লাইব্রেরি মাঠ, নিজ বাড়ি ও লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে নেয়া হয়। সেখানে রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ শ্রদ্ধা জানান। তারা বলেন, একজন সর্বজন নন্দিত মানুষকে এভাবে হত্যার বিষয়টি তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন তারা।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী : বৃহস্পতিবার বিকেলে রংপুর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আরিফা ইয়াসমিন মুক্তার আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আল-আমিন গ্রেফতার অ্যাডভোকেট বাবু সোনার সহকারী ও স্ত্রী দীপার ঘনিষ্ঠজন মিলন মোহন্তকে হাজির করলে তিনি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। পরে অন্যদের সাথে তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়।

একাধিক প্রেমিক ছিল দীপার : তাজহাট উচ্চবিদ্যালয় এবং কামরুল ও দীপাকে জিজ্ঞাসাবাদের সাথে যুক্ত তদন্ত সংস্থাগুলোর সূত্র মতে, ১৯৯৪ সালের ৮ অক্টোবর একই দিনে ইসলাম ধর্মের শিক্ষক হিসেবে কামরুল ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের শিক্ষক হিসেবে দীপা নিয়োগ পান। তাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন সেই সময়ে স্কুলের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্য মতে, রথীশের সাথে দীপার বিয়ের পর থেকেই পারিবারিক অশান্তি শুরু হয় এবং দীপা পরপুরুষে আসক্ত ছিলেন। স্কুলে নিয়োগ পাওয়ার পরপরই তিনি কামরুলের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। একই স্কুলের আরেক শিক্ষক মতিয়ার রহমান ও বাবু সোনার অফিস সহকারী মিলন মোহন্ত ছাড়াও আরো কয়েকজনের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তবে কামরুলের সাথে তার সম্পর্কের বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট।

কামরুল ও দীপাকে জিজ্ঞাসাবাদের সাথে যুক্ত কর্মকর্তাদের সূত্র মতে, অনৈতিক সম্পর্কের সূত্র ধরে কামরুল দীপার কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের ধারণা, নগরীর রাধাবল্লভে কামরুলের যে দোতলা বাড়ি আছে, সেটি নির্মাণের খরচও দিয়েছেন দীপা। কামরুল যে মোটরসাইকেলটি ব্যবহার করতেন সেটিও দীপার কিনে দেয়া কি না তাও খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।

কামরুল ও দীপাকে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের সূত্র মতে, কামরুল ছাত্রজীবনে জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করলেও ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তাজহাট স্কুলের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেই সময়ের সভাপতির আনুকূল্যে একজন জুনিয়র শিক্ষক হয়েও নিয়মবহির্ভূতভাবে কামরুল বিভিন্ন পদ পদবি পান এবং নিয়োগসহ আর্থিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি করেন স্কুলটিতে। ওই সময়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তার হাতের পুতুল।

সূত্র মতে, স্কুল পরিচালনা কমিটির সেই সময়ের সভাপতি মারা যাওয়ার পর নতুন সভাপতি হন অ্যাডভোকেট বাবু সোনা। পরে তিনি শিক্ষক কামরুলের সব অবৈধ হস্তক্ষেপ কঠোরহস্তে দমন করেন এবং সিনিয়র শিক্ষকদের যথাযথভাবে দায়িত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার মাধ্যমে স্কুলে অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং হওয়ার পাশাপাশি বহু উন্নয়ন হয়েছে। স্কুলের জমি নিয়ে সমস্যার সমাধান হয়েছে কোর্টের রায়ের মাধ্যমে গত ১৪ মার্চ। কিন্তু কামরুল অবৈধ ক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারায় স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরিসহ বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ শুরু করেন। তাকে এ কাজে সাহস দেন প্রেমিকা ও সহকর্মী দীপা ভৌমিক।

সূত্র মতে, অব্যাহত শৃঙ্খলাবিরোধী কাজের কারণে গত ৪ মার্চ স্কুলের সভাপতির নির্দেশে প্রধান শিক্ষক তিনটি বিষয় উল্লেখ করে কারণ দর্শাও নোটিশ দেন কামরুলকে। বিষয়টি নিয়ে দীপা নাখোশ হন স্বামীর ওপর। এ নিয়ে কথাকাটাকাটি হয় তাদের মধ্যে।

সূত্র মতে, কামরুলের সাথে দীপার অনৈতিক সম্পর্ক এবং স্কুলে কামরুলের অবৈধ হস্তক্ষেপে দীপার সমর্থন ও কামরুলকে কারণ দশাও নোটিশ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের চরম অবনতি হয়। বিষয়টি নিয়ে সমঝোতার জন্য ৩০ মার্চ রাতে পারিবারিক সালিসের দিন ধার্য করা হয়। কিন্তু পূর্বপরিকল্পনার অনুযায়ী ২৯ মার্চ রাতেই নিজ বাড়ির শয়নকক্ষে দীপা ও কামরুল অ্যাডভোকেট বাবু সোনাকে হত্যা করেন।

তদন্ত সূত্রগুলোর তথ্য মতে, ২৯ তারিখ রাতে বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর পর ওড়না পেঁচিয়ে বাবু সোনাকে হত্যা করেন দীপা ভৌমিক ও কামরুল। লাশের গলায় ওড়না দিয়ে পেঁচানো সেই দাগ রয়েছে। এ সময় তার পরনে শার্ট-প্যান্ট ও পায়ে জুতা ছিল। লাশ পেঁচানো ছিল বিছানার চাদর ও লুঙ্গি দিয়ে। সুরুত হাল রিপোর্টেও সেসব বিষয় উঠে এসেছে। কামরুলের পৈতৃক বাড়ি তাজহাট মোল্লাপাড়ায়। তিনি পরিবার নিয়ে নগরীর রাধাবল্লভ এলাকায় বাস করলেও মোল্লাপাড়ার বাড়িতেও মাঝে মধ্যে যাতায়াত করতেন।

তাজহাট স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য : তাজহাট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাওহিদা খাতুন জানান, একই দিনে নিয়োগ পাওয়া ধর্মীয় শিক্ষক কামরুল ছ্যাবলা টাইপের হলেও দীপা ভৌমিক ছিল শান্তশিষ্ট স্বভাবের। তাদের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক থাকার বিষয়ে শোনা গেলেও স্কুলে সেটি পরিলক্ষিত হয়নি।

তিনি বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেই সময়ের স্কুলের সভাপতি মরহুম আওয়ামী লীগ নেতা আবুল মনসুর আহমদের ছত্রছায়ায় কামরুল আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে স্কুলে অনিয়ম ও দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেন। তার ইশারায়ই সব হচ্ছিল। অ্যাডভোকেট বাবু সোনা আগেও স্কুলের কমিটিতে ছিলেন কিন্তু অন্য দায়িত্বে।

অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হয়ে এসে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তিনি বিল্ডিংসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেন এবং কামরুলকে সরিয়ে সিনিয়র শিক্ষকদের দিয়ে সব কাজ করাতেন। এ কারণে কামরুল স্কুলে সব সময়ই চেষ্টা করতেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির। এ জন্য গত ৩ মার্চ তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়ারও নির্দেশ দেন সভাপতি বাবু সোনা। সময় না থাকায় আমি পরদিন নোটিশ দেই। ১৯ মার্চের বৈঠকে নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় একটি তদন্ত কমিটি করে দেই। সেই কমিটি ২৮ মার্চ তাকে আমার রুমেই জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার পরের দিনই কামরুল ও দীপা বাবু সোনাকে হত্যা করলেন। বিষয়টি দুঃখজনক।

তিনি অ্যাডভোকেট বাবু সোনা হত্যাকাণ্ডে জড়িত কামরুল ও দীপার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে বলেন, আমরা পরে জানতে পেরেছি ভয়ভীতি দেখিয়ে স্কুলের দুই ছাত্রকে দিয়ে মোল্লাপাড়ায় নিজের ভাইয়ের পরিত্যক্ত বাড়ির খোলা রুমের মেঝের ওই গর্ত খুঁড়ে নিয়েছিলেন কামরুল। ওই ছাত্রের বাড়িও মোল্লাপাড়ায়ই।

কামরুল ও দীপাকে বরখাস্ত করার ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক তাওহিদা জানান, অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ছিলেন বাবু সোনা, তিনি নেই। শিক্ষক প্রতিনিধি মতিয়ার রহমানকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী নিয়ে গেছে। সে কারণে আমি কমিটির মিটিং করতে পারছি না। বোর্ডে নির্দেশনা চেয়েছি। বোর্ডের নির্দেশনা আসামাত্রই তাদের বরখাস্তসহ সব কিছু করা হবে।
শোক র‌্যালি : এ দিকে বাবু সোনা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রংপুরের আইনজীবীরা তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছেন। তারা কালোব্যাজ পরে শোক র‌্যালি করেছেন। শোক র‌্যালি থেকে দীপা ও কামরুলের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করা হয়। এ ছাড়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদও নগরীতে শোক র‌্যালি করেছে।
এ দিকে রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান সাইফ জানান, রথীশ ভৌমিকের সহকারী মিলন মোহন্ত ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। এ ছাড়াও লাশ গুম করার জন্য ব্যবহৃত স্টিলের আলমিরা ও একটি মোটরসাইকেল কামরুলের ভাইয়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ২৯ মার্চ রাত ১০টার দিকে রংপুর মহানগরীর তাজহাট বাবুপাড়ায় অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করেন স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার দীপা ভৌমিক ও তার প্রেমিক কামরুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় রথীশের স্ত্রী তাজহাট উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক স্নিগ্ধা সরকার দীপা ভৌমিক, সহকারী শিক্ষক ও প্রেমিক কামরুল ইসলাম, সহকারী শিক্ষক ও স্কুল ম্যানেজিং কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি মতিয়ার রহমান, স্কুলের শিক্ষার্থী মোল্লাপাড়ার রফিকুল ইসলামের ছেলে সবুজ ইসলাম, রবিউল ইসলামের ছেলে রোকনুজ্জামান, ডিমলা কানন গোটলার আলম শেখের ছেলে দেলোয়ার হোসেন, মৃত হায়দার আলীর ছেলে মো: রফিক মিয়া, ছালাম মিয়ার ছেলে জিয়ারুল মিয়া ও আজহারুল মিয়ার ছেলে বাহারুল মিয়া ও বাবু সোনার সহকারী মিলন মোহন্তকে গ্রেফতার করেছে।

বাবু সোনার একমাত্র ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করছেন। একমাত্র মেয়ে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী।